বাংলাদেশে ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থার বিপুল সম্ভাবনা - BANGLANEWSUS.COM
  • নিউইয়র্ক, সকাল ৯:৫৯, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ


 

বাংলাদেশে ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থার বিপুল সম্ভাবনা

প্রকাশিত এপ্রিল ৬, ২০১৯
বর্তমান যুগ জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগ। তথ্য-প্রযুক্তির উন্নয়ন সাধারণ মানুষের জীবনে যেমন স্বস্তি বয়ে এনেছে তেমনই বিপরীতে রয়েছে অস্বস্তির নীল নিঃশ্বাস। ভোক্তা অধিকার একটি মৌলিক অধিকার। যা কিনা সংবিধানের ২৬ থেকে ৪৭ (ক) এ নিশ্চিত করা আছে। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালে ভোক্তা অধিকার আইন পাস করে। যেখানে খাদ্য, চিকিত্সা, পণ্য, ওষুধ ও সেবা খাতের ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ডিজিটাল খাতের গ্রাহকদের সেবা খাতের অন্তর্ভুক্ত করা হলেও এ খাতে ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আইনটি ডিজিটালবান্ধব না হওয়ায় এ খাতের ভোক্তারা সবচেয়ে ভোগান্তি ও প্রতারণার শিকার হচ্ছে।
ইন্টারনেট ও স্মার্টফোনের কল্যাণে অনলাইনে কেনাকাটার যে ধারা ধীরে ধীরে বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে তা আরো ব্যাপক আকার ধারণ করার সম্ভাবনা রয়েছে। শহরের তুলনায় গ্রামে এই খাতটি আরো সম্ভাবনাময়। কারণ শহরে যেসব পণ্য সচরাচর পাওয়া যায় গ্রামে সেটি পাবার সম্ভাবনা খুবই কম। আবার গ্রামে অনেক মানুষ আছেন যাদের ক্রয়ক্ষমতাও রয়েছে। কারণ হাজার হাজার কোটি টাকার রেমিটেন্স আসে যার অধিকাংশ গ্রামে বা ছোট শহরে যায়। গ্রামীণ এলাকা অনলাইন বা ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থার অন্যতম ভিত্তি হতে পারে। বাংলাদেশে ডিজিটাল শব্দটি ২০০৯ সালের পর থেকে ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়ে আসছে। মূলত বাংলাদেশকে তথ্য প্রযুক্তিতে উন্নত করে বৈশ্বিক উন্নয়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার জন্যই এই ধারণার প্রণয়ন করা হয়েছে। বর্তমান বিশ্বে ডিজিটাল বা অনলাইন বাজার ব্যবস্থা অনেক জনপ্রিয় হয়েছে। বাংলাদেশেও এর ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ঘরে বসে ইচ্ছেমত কেনাকাটা, পণ্য পছন্দ করা, সেটি সম্পর্কে বিস্তারিত সহজেই জানতে পারা এবং যানজট এড়িয়ে দোকানে ঘুরে ঘুরে ক্লান্তি করে পণ্য কেনার চেয়ে ঘরে বসে খুব সহজেই পছন্দের সহজলভ্যতার জন্য ধীরে ধীরে আরো জনপ্রিয়তা অর্জন করছে অনলাইন বাজার ব্যবস্থা।
বাংলাদেশের একটি জরিপে দেখা গেছে, আগামী ২৫ বছরে বাংলাদেশে আনুপাতিকহারে তরুণদের সংখ্যা সর্বাধিক বৃদ্ধি পাবে। এ প্রেক্ষিতে ই-কমার্স বা অনলাইন খাত বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা গেলে বাংলাদেশের জন্য একটি অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হবে। Goldman Sachs ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, বাংলাদেশ Next Eleven গ্রুপের অন্যতম সদস্য হিসেবে সামর্থ্য ও সম্ভাবনার কারণে ২১ শতকের অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটির ৬৫% মানুষের বয়স ৩৫ বছরের নিচে। সংখ্যার দিক থেকে তাই বাংলাদেশ শুধুমাত্র নয়, যুব সম্প্রদায়ের দিক থেকে বৃহত্ একটি দেশ। প্রতি বছর গড় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৭% এবং বর্ধিষ্ণু নগরায়ণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির আয় বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশের এ মধ্যবিত্ত শ্রেণিই অনলাইন বা ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি হবে।
বাংলাদেশে ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থা বিস্তারের পথে তিনটি বাধা চিহ্নিত করা যেতে পারে। প্রথম কারণটি, অনলাইনভিত্তিক বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানসমূহ এখনো মানুষের পুরোপুরি আস্থা অর্জন করতে পারেনি। দ্বিতীয় কারণটি হলো, বাংলাদেশে নির্ভরযোগ্য ডেলিভারি ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। বাংলাদেশে ডাকবিভাগ সম্প্রতি চেষ্টা শুরু করেছে, কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা সারা দেশে ই-কমার্স ডেলিভারির ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারেনি। তৃতীয়, বর্তমানে নির্ভরযোগ্য পেমেন্ট সিস্টেমও নেই। সীমিত পরিসরে ই-কমার্স বা অনলাইন বাজার চালু করা গেলেও দেশের ৭০ ভাগ গ্রামীণ মানুষ এর আওতার বাইরে।
ডিজিটাল বাজার বা অনলাইন বাজার ব্যবস্থা ধীরে ধীরে যেমন জনপ্রিয়তা অর্জন করছে ঠিক তেমনই কিছু কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর অসদুপায় পন্থা অবলম্বনের জন্য এই খাত কলঙ্কিত হচ্ছে। অনলাইন কেনাকাটার ক্ষেত্রে অনেক ফাঁকফোকর রয়ে গেছে। আর তাই প্রতিনিয়ত ক্রেতারা ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন। হচ্ছেন প্রতারিত। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম (ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব) বা ওয়েব সাইটে প্রচারণার উপর ভিত্তি করে সাধারণত অনলাইন বাজার গড়ে ওঠে। অনলাইনে পণ্যের ধরন, রঙ, সর্বোপরি গুণগত মান যেভাবে বর্ণনা করা থাকে ক্রেতার নিকট যখন পণ্যটি পৌঁছে তখন দেখা যায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পূর্বের সঙ্গে মিল থাকে না। সেসব পণ্য নিতে না চাইলে ক্রেতাকে ডেলিভারি চার্জ বহন করতে হয়। আবার বর্তমানে পশু বিক্রয়ের জন্য অনলাইন মাধ্যমও ব্যবহূত হয়ে আসছে। বিশেষ করে কোরবানির ঈদের সময় হাটে যেয়ে পশু কেনার ভোগান্তি এড়াতে এই বাজারের চাহিদা বহুগুণে বেড়ে যায়। তখন দেখা যায় অনলাইনে দেওয়া বিজ্ঞাপনের সঙ্গে পশুর তেমন মিল নাই। আবার আরেকটি বড় সমস্যা হলো পণ্য পরিবহনের বিষয়টি। মূলত বাংলাদেশের সিংহভাগ ব্যবসা কার্যক্রম রাজধানীকেন্দ্রিক। পণ্য উত্পাদন বা আমদানির মূল কেন্দ্র ঢাকা। অনলাইনে কোনো পণ্যের অর্ডার করলে ঢাকার মধ্যে ক্রেতার অবস্থান হলে সেইদিনই বা তার পরেরদিনের মধ্যেই পণ্য পৌঁছে দেওয়া হয়। আর ঢাকার বাইরে হলে ৭ থেকে ১০ দিন পর্যন্ত সময় লেগে যায়। এর প্রধান কারণ হলো আমাদের দেশে এখনো লজিস্টিকস বা পরিবহন কোম্পানি গড়ে ওঠেনি যার ফলে ক্রেতার কাছে পণ্য দ্রুত সময়ের মধ্যে পৌঁছে দিতে পারে। ইন্টারনেটের উচ্চমূল্য ডিজিটাল বাজার অন্যতম একটি বাধা। আবার গ্রামের ইন্টারনেটের গতি তুলনামূলক আরো কম। ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থায় আরেকটি সমস্যা হলো বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব। গত কয়েক বছরে হাজার হাজার উদ্যোক্তা অনলাইন মার্কেট তৈরি করে ব্যবসা আরম্ভ করেছে। কোনো ক্রেতা যদি একবার প্রতারিত হয় বা আস্থা হারিয়ে ফেলে তাহলে ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থার উপর সামগ্রিকভাবেই আস্থা হারিয়ে ফেলে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে অনেকেই ফেসবুক পেইজ খুলে স্পন্সর করে (ফেসবুক পেইজ বুস্ট) সকলের কাছে পৌঁছে দেওয়ার মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় করছেন যাদের অনেকের মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতারণার মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেওয়া। আরেকটি গুরুতর সমস্যা হলো একটি পণ্যের দাম বাজারে যে মূল্যে বিক্রয় হয় তার থেকে অনেক বেশি মূল্যে বিক্রয় করে থাকে অনলাইনভিত্তিক কোম্পানিগুলো। আবার একই পণ্য বিভিন্ন কোম্পানি অসঙ্গতিপূর্ণ বিভিন্ন মূল্যে বিক্রয় করে থাকে। অনলাইনে কেনা-বেচা সংক্রান্ত লেনদেনের অন্যতম মাধ্যম ব্যাংক। আর এ বাবদ ব্যাংকপ্রতি লেনদেনে ফি কেটে থাকে ৪ শতাংশ হারে। অথচ ব্রিটেনে প্রতি ২৭টি লেনদেন বাবদ ব্যাংকগুলো ফি রাখে মাত্র ৫ পাউন্ড।
বাংলাদেশে ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থা অত্যন্ত সম্ভাবনাময় খাত। অসাধু উপায় বন্ধ করলে এটি আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। এই খাতে ভোগান্তি এড়াতে প্রস্তাবনাসমূহ:অনলাইন বাজার ব্যবস্থা অর্থাত্ ই-কমার্স সহায়ক উপযুক্ত জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। ই-কমার্সের উন্নয়নে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ তৈরি করতে হবে। আর্থিক লেনদেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। ইন্টারনেটের গতি বৃদ্ধি করতে হবে এবং ডেটার মূল্য সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে। আস্থাশীল ই-কমার্স পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকার ও অনলাইন বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে। অনলাইন কেনাকাটার জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে জনগণকে সচেতন করে তুলতে হবে। ভোক্তা অসন্তোষ নিরসনের মেকানিজমের অভাব দূর করতে হবে। ব্যাংকের মাধ্যমে লেনদেনের খরচ পুনঃনির্ধারণ করতে হবে। অনলাইনে পণ্য বিক্রয় করার জন্য সরকারের নির্ধারিত অধিদপ্তর থেকে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করতে হবে। অনলাইনে পণ্য বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত অফিস থাকা বাধ্যতামূলক করতে হবে। ক্রেতা প্রতারিত হলে অভিযোগ করার প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে এবং অভিযোগটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে হবে। কোনো প্রকার শর্ত ছাড়া পণ্য হাতে পাবার পরে মূল্য পরিশোধের সুব্যবস্থা করতে হবে। সরকার কর্তৃক মনিটরিং সেল গঠন ও নিয়মিত মনিটরিং করতে হবে। ইন্টারনেটে ব্যবসাকারী সকল কোম্পানির আয়ের হিসাব সরকারের কাছে প্রদর্শন করতে হবে। অনলাইনে পণ্য বিক্রয়কারী সকল প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। বিবরণ অনুযায়ী পণ্য না পেলে কিংবা ত্রুটিপূর্ণ পণ্য পেলে তা সহজেই ফেরত নিয়ে পরিবর্তন করে দিতে হবে এবং পণ্য পরিবর্তনের যাবতীয় খরচ বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানকেই বহন করতে হবে। জাতীয় ভোক্তা অধিদপ্তরের কার্যক্রম উপজেলা পর্যায়ে পৌঁছে দিতে হবে। অভিযোগ দায়েরের পর দ্রুততম সময়ে বিষয়টির সুরাহা করতে হবে।
উন্নত দেশগুলো ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমে ব্যাপক উন্নতি করেছে। সময় ও শ্রম কম দিতে হয় বলে এই খাতে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। অতিরিক্ত মুনাফা লাভের আশা ত্যাগ করে সেবাদানের মানসিকতা তৈরি করলে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে ডিজিটাল বাজার ব্যবস্থাকে আরো জনপ্রিয় করা সম্ভব। অধিক ঘনবসতিপূর্ণ আমাদের এই বাংলাদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, উত্পাদিত পণ্য পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়ে একদিকে যেমন বেকার সমস্যা সমাধান করা সম্ভব তেমনি বিশ্বের সাথে বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক গড়ে তোলা সম্ভব।
 লেখক : মো. আখতার হোসেন আজাদ, শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।