বেনাপোল-শার্শা (যশোর) :
ভারতের পেট্রাপোলে সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি বাংলাদেশি আমদানিকারকরা। এজন্য বেনাপোল-পেট্রাপোল বন্দর দিয়ে দুই দেশের মধ্যে আমদানি-রফতানি বন্ধ হওয়ার পথে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁ পৌরসভার মেয়রের খামখেয়ালিপনা, আমদানি-রফতানিতে নাক গলানো, পৌরসভার কালিতলা পার্কিং সৃষ্টি করে বিভিন্ন রাজ্য থেকে আসা আমদানিকৃত পন্যবাহি ট্রাকগুলো জোরপূর্বক পেট্রাপোল বন্দরের সেন্ট্রাল ওয়্যারহাউস করপোরেশনের টার্মিনালে না পাঠিয়ে চাঁদার জন্য কালিতলা পার্কিংয়ে রেখে দেয়ার কারণে এ অবস্থা তৈরি হয়েছে।ভারত থেকে পণ্যবাহী ট্রাকগুলো পেট্রাপোল বন্দরে প্রবেশের আগে ২০ দিনেরও বেশি সময় আটকে রাখা হয়। পেট্রাপোল স্থলবন্দরের সিন্ডিকেট কর্তৃক অব্যবস্থাপনা এবং অনিয়মের কারণে অযৌক্তিক বিলম্বে বাংলাদেশি আমদানিকারকদের জন্য নতুন উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।স্থানীয় ব্যবসায়ীদের মতে, অনেকবার চেষ্টা করে তারা সিন্ডিকেট থেকে মুক্তি পাননি। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রতিবারই বলছে তারা বিষয়টি সমাধানের চেষ্টা করছে। সিরিয়ালের নামে বনগাঁর অধীনে বন্দরের ভারতীয় অংশে পার্কিং সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বেনাপোলগামী পণ্যবাহী ট্রাক ২০ দিনেরও বেশি সময় ধরে আটকে রাখা হয়।ভারতের বিভিন্ন রাজ্য থেকে আমদানিকৃত পণ্যবাহী ট্রাকগুলো পেট্রাপোলে প্রবেশের ২০ থেকে ২৫ দিন আগে জোর করে বনগাঁ পৌরসভার নামে তৈরি করা পার্কিংয়ে রাখা হয়। ফলে আমদানিকারকরা চরম ক্ষতির মুখে পড়ছেন।পার্কিংয়ে যে কয়েকদিন পণ্যবাহী ট্রাক থাকবে সে কয়েকদিনের টাকা ভারতের রফতানিকারকরা বাংলাদেশি আমদানিকারকদের কাছ থেকে আদায় করে নেন। অনেকে জরুরিভাবে মাল নিতে চাইলে বনগাঁ সিন্ডিকেটের সঙ্গে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা চুক্তিতে মাল নেন। সেখান থেকে প্রতিদিন নিজেদের ইচ্ছামতো কবে কোন ট্রাক বাংলাদেশে যাবে তা তারাই নির্ধারণ করে দেয়ালে কাগজ (টোকেন) টানিয়ে দেন। দীর্ঘ অপেক্ষার কারণে আমদানিকৃত পণ্যগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শিল্পের কাঁচামাল সময়মতো কারখানায় পৌঁছাতে না পারায় শিল্প কার্যক্রম ব্যাহত হয়। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হন ট্রাক চাল পেট্রাপোল স্থলবন্দরটির বাণিজ্যিক যাত্রা শুরু হয়েছিল বেনাপোল বন্দর দিয়ে ১৯৭২ সালে। ভারতের প্রধান বাণিজ্যিক শহর কলকাতা বন্দর থেকে বেনাপোল বন্দরের দূরত্ব মাত্র ৮৪ কিলোমিটার। অল্প সময়ে যাতাযাতের কারণে উভয় দেশের ব্যবসায়ীরা আমদানি-রফতানি কার্যক্রমের জন্য এই রুটটিকে পছন্দ করেন।আমদানি করা মালামালগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই শিল্পের কাঁচামাল। দেশের চলমান ১২টি স্থলবন্দরের মধ্যে সবচেয়ে বড় আর বেশি রাজস্বদাতা বন্দর বেনাপোল। বাণিজ্যিক দিক দিয়ে চট্টগ্রামের পরই বেনাপোল বন্দরের স্থান।প্রতি বছর এ বন্দর দিয়ে ভারতের সঙ্গে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকার আমদানি বাণিজ্য হয়। যা থেকে সরকারের প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আসে। নানা সমস্যায় এ পথে আমদানি কমে যাওয়ায় গত তিন বছরে সরকারের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে রাজস্ব ঘাটতি হয়েছে চার হাজার ১০০ কোটি টাকা।ব্যবসায়ীদের মতে, কলকাতা থেকে ছেড়ে আসা একটি ট্রাক সমস্ত প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে মাত্র পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে বেনাপোল বন্দরে পৌঁছতে পারে। তবে চাঁদাবাজির অভিযোগে বনগাঁ পৌরসভার আওতাধীন কালিতলা পার্কিংয়ে ট্রাকগুলো সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে।বিগত প্রায় দুই যুগ ধরে এ অনিয়ম চলে আসলেও সিন্ডিকেটের হাত থেকে কোনোভাবে মুক্তি মিলছে না ব্যবসায়ীদের। এই সমস্যার কারণে কিছু ব্যবসায়ী বন্দরের মাধ্যমে তাদের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছেন। ফলে সরকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।আমদানি পণ্যবহনকারী ভারতীয় ট্রাক চালকেরা বলছেন, বেনাপোল বন্দরে প্রবেশের আগেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে বনগাঁ কালিতলা পার্কিংয়ে সিরিয়ালের নামে পণ্যবাহী ট্রাক ১৫ থেকে ২০ দিন পর্যন্ত আটকে রাখা হয়। সিরিয়ালের জন্য ট্রাক ভেদে ৫০ থেকে ২০০ টাকা চাঁদা দিতে হয়। এতে তারা দ্রুত পণ্য নিয়ে বেনাপোল বন্দরে পৌঁছাতে পারেন না। তারা নানাভাবে ভোগান্তির শিকার হন।বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ স্টাফ অ্যাসোসিয়শনের সাধারণ সম্পাদক সাজেদুর রহমান বলেন, বনগাঁ পার্কিংয়ের এই চাঁদাবাজির কারণে অনেক ব্যবসায়ী আমদানি কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে বেশ কয়েকবার দুই বন্দর কর্তৃপক্ষকের কাছে অভিযোগ দেয়া হলেও তার সুফল এখনও পাননি আমদানিকারকর বেনাপোল বন্দর ট্ট্রান্সপোর্ট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আজিম উদ্দীন গাজী বলেন, বাংলাদেশ থেকে রফতানি বাণিজ্যে বেনাপোল বন্দর এলাকায় কোনো ট্রাক পার্কিং বা চাঁদাবাজি নেই। কিন্তু ভারত থেকে আমদানির সময় বনগাঁয় পার্কিং বানিয়ে নীরব চাঁদাবাজি করা হয়। অনেক চেষ্টা করেও এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না।বেনাপোল আমদানি-রফতানি সমিতির সভাপতি মহসিন মিলন বলেন, পার্কিংয়ে দিনের পর দিন ট্রাক আটকে থাকায় পণ্যের মান খারাপ হয়। কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয়। কার্গো ট্রাকগুলো একদিনে কলকাতা থেকে বেনাপোল বন্দরে যাতে পৌঁছতে পারে সে ব্যাপারে উচ্চপর্যায়ে আলোচনা না করলে সমস্যা সমাধান করা সম্ভব নয়।বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মফিজুর রহমান সজন বলেন, প্রায় দুই দশক ধরে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের ভারতীয় ট্রাক পার্কিং সিন্ডিকেট জিম্মি করে রেখেছে। ভারতীয় হাই কমিশনারসহ বিভিন্ন মহলে আবেদন করার পরেও —আমরা কোনো সমাধান পাচ্ছি না।বিষয়টি স্বীকার করে পেট্রাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টস স্টাফ ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্ত্তিক চক্রবর্তী বলেন, আমরা বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।বেনাপোল স্থলবন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (প্রশাসন) আব্দুল জলিল বলেন, ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে বনগাঁ পার্কিংয়ের অনিয়মের ব্যাপারে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অনেকবার কথা বলা হয়েছে। আশা করছি খুব দ্রুত সমস্যার সমাধান হবে।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।