বিশেষ প্রতিনিধিঃ
দেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ে আক্রান্তদের মধ্যে দ্রুত মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। করোনার প্রথম ঢেউয়ে যেখানে ৬ থেকে ৭ দিনে মারাত্মক আক্রান্তদের মৃত্যু ঘটত, সেখানে বর্তমানে মাত্র ৫ দিনের মধ্যেই মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। মূলত ভাইরাসের নতুন নতুন ভেরিয়েন্টের মাধ্যমে সংক্রমণ ছড়ানো, আক্রান্ত হওয়ার পর দ্রুত চিকিৎসা না নেওয়া ইত্যাদি কারণে এবার দ্রুত মৃত্যু ঘটছে-এমন মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের।
তারা বলছেন, সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করতে পারলেই মৃতের সংখ্যা কমে আসবে। প্রয়োজনীয় অক্সিজেন না পাওয়া এবং নানা ধরনের রোগে আক্রান্তদের মৃত্যু ঘটছে স্বল্প সময়ে। যা মোট মৃত্যুর প্রায় অর্ধেক।
সম্প্রতি করোনা মহামারির মৃত্যুর কারণগুলো পর্যালোচনা করে রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআরও এক প্রতিবেদনে বলেছে, হাসপাতালের ভর্তির দিন থেকে ৫ দিনের মধ্যে মৃত্যু ঘটছে ৪৮ শতাংশ মানুষের।
গত বছরের ফেব্রুয়ারি-এপ্রিল মাসের সঙ্গে এ বছরের একই সময়ের তুলনামূলক চিত্র বিশ্লেষণ করে আইইডিসিআর দেখিয়েছে, কোভিড উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তির ৫ দিনের মধ্যে ১০ শতাংশ রোগীর মৃত্যু হয়েছে। পরবর্তী ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৮ শতাংশ মানুষের; ১১ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২৮ শতাংশ মানুষের; ১৬ থেকে ২০ দিনের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৮ শতাংশ মানুষের এবং ২০ দিনের পরে মৃত্যু হয়েছে ২৬ শতাংশ মানুষের।
একইভাবে হাসপাতালে ভর্তির দিন থেকে মৃত্যুর হিসাবে দেখা গেছে, ভর্তির ৫ দিনের কম সময়ে মৃত্যু হয়েছে ৪৮ শতাংশ মানুষের। পরবর্তী ৫ থেকে ১০ দিনের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৩২ শতাংশ মানুষের; ১১ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১২ শতাংশ মানুষের; ১৬ থেকে ২০ দিনের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ২ শতাংশ মানুষের এবং হাসপাতালে ভর্তির ২০ দিন পরে মৃত্যু হয়েছে ৬ শতাংশ মানুষের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (এনসিডিসি-অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ) ও মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিন যুগান্তরকে বলেন, এ ধরনের গবেষণার তথ্যগুলো আরও পরিষ্কার হওয়া উচিত। দ্রুত মৃত্যুর কারণ হিসাবে তিনি বলেন, শরীরে উপসর্গ দেখা দিলেই হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। কারণ অনেক রোগীরই অক্সিজেনের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সঠিক সময়ে হাসপাতালে ভর্তি না হওয়ায় সেটি দেওয়া সম্ভব হয় না।
ফলে অক্সিজেনের ঘাটতিজনিত কারণে তাদের মৃত্যু ঘটে। এছাড়া অনেকের ফুসফুসে মারাত্মক সংক্রমণ হয়। এমনকি ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ পর্যন্ত সংক্রমণ ঘটে থাকে। এক্ষেত্রে দ্রুতই রোগীর মৃত্যু হয়।
পাশাপাশি ভাইরাসটির নতুন নতুন ভেরিয়েন্টের সংক্রমণের কারণেও মৃত্যু হয়ে থাকে। তিনি বলেন, গত বছরেও আমরা দেখেছি মারাত্মকভাবে যারা আক্রান্ত হন বা যাদের শরীরে দ্রুত সংক্রমণ ঘটে ৬ থেকে ৭ দিনের মধ্যে তাদের মৃত্যু ঘটে। এবার এক থেকে দুদিন কমে ৫ দিনের মধ্যে মৃত্যু ঘটছে।
বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের স্বজনরা জানান, করোনা পরীক্ষায় পজিটিভ হলে এবং তৎক্ষণাৎ মারাত্মক অসুস্থ না হলে চিকিৎসকরা ঘরে বসে চিকিৎসা নিতে পরামর্শ দেন। এমনকি রোগীর অবস্থার অবনতি হতে থাকলে অনেক হাসপাতাল ঘুরেও শয্যা পাওয়া যায় না।
শয্যা পেলেও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শুরু হতে সময় লাগে। যাদের আইসিইউ (ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট-নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) প্রয়োজন হয় তাদের জন্য আইসিইউ পাওয়া যায় না। ফলে রোগীদের মৃত্যু ঘটে।
সম্প্রতি সময়মতো প্রয়োজনীয় চিকিৎসা না পেয়ে লাবণ্য নামের এক সংবাদকর্মীর মায়ের মৃত্যু হয়েছে। তিনি জানান, তার মায়ের কোভিড পজিটিভ হওয়ার পর অনেক হাসপাতাল ঘুরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে ভর্তি করতে সমর্থ হন। কিন্তু ভর্তির পর দ্রুত তার স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটলে চিকিৎসকরা আইসিইউতে নেওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু তৎক্ষণাৎ আইসিইউ না পাওয়ায় তার মায়ের মৃত্যু হয়।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও ইউজিসি অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, সংক্রমণ বাড়লে মৃত্যু বাড়বেই। বিশেষ করে যাদের বয়স বেশি, হার্টের রোগ রয়েছে, উচ্চরক্ত চাপ রয়েছে, ডায়াবেটিস আক্রান্ত অথবা অন্য জটিল রোগে আক্রান্ত তাদের মৃত্যু বেশি হচ্ছে। তিনি বলেন, এই অবস্থার উত্তরণে রোগের প্রকোপ ও রোগী কমাতে হবে। এ জন্য স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মানতে হবে।
গত ২৮ জানুয়ারি থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে আইইডিসিআর বলছে, এ সময় আক্রান্তদের ৪৪ শতাংশই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ৩৩ শতাংশ রোগী প্রাতিষ্ঠানিক আইসোলেশনে, ১৭ শতাংশ বাড়িতে এবং ছয় শতাংশ অন্যান্য উপায়ে চিকিৎসা নিয়েছেন।
যাদের মৃত্যু হয়েছে তাদের ৫২ শতাংশই উপসর্গ শুরুর পাঁচদিনের মধ্যে হাসপাতালে ভর্তি হন। ২৬ শতাংশ পাঁচ থেকে ১০ দিনের মধ্যে এবং ১২ শতাংশ হাসপাতালে ভর্তি হন উপসর্গ শুরুর ১১ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পাঁচদিনের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ৪৮ শতাংশের এবং পাঁচ থেকে ১০ দিনের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১৬ শতাংশ রোগীর।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।