চীন দেশেই চায়ের আদি জন্মভূমি। ১৬৫০ খ্রীষ্টাব্দে চীনে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়। আর ভারতবর্ষে চায়ের চাষ শুরু ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে। ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা সিলেটে সর্বপ্রথম চায়ের গাছ খুঁজে পায়। পাঁচ হাজার আগের একটি কাকতালীয় ঘটনাই আজকের ধোঁয়াওঠা চায়ের কাপের পর্দার পেছনের কাহিনী, যাকে আমরা বলি ইতিহাস।
সম্রাটদের খামখেয়ালীপনার শত গল্পই দেখা যায় এই ইতিহাসের পাতা উল্টালে, কারো রাজ্য জয় পরাজয়-কারো অদ্ভুত শখ বা কারো গভীর প্রেম, সবকিছুই বর্তমানের কোনো না কোনো কিছুতে সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলেছে। তেমনি এক সম্রাট ছিলেন আমাদের আজকের এই শেণ নাং, চায়ের কথা বললে যার নাম বলতেই হয়।
মজার ব্যাপার হলো চীনা ভাষায় শেন নাং নামটির অর্থ হলো স্বর্গীয় কৃষক। শেন নাং ও যেনো স্বর্গ থেকে ছেনে এনেছিলেন চা নামের প্রিয় পানীয়টি। এর পাঁচ হাজার বছর আগের এই সম্রাট ছিলেন দারুন স্বাস্থ্য সচেতন। একবার তিনি ডিক্রি চালু করলেন যে তার প্রজাদের সবাইকে পানি ফুটিয়ে পান করতে হবে। তো একদিন বিকেলে রাজকার্যের ক্লান্তি দূর করার জন্য ক্যামেলীয়া গাছের নীচে বসে সম্রাট ফুটানো গরম পানি পান করছিলেন, কোত্থেকে যেন তার গরম পানির পাত্রে এসে পড়লো কয়েকটি অচেনা পাতা। পাতাগুলো পানি থেকে বের করার আগেই তার নির্যাস মিশে যেতে লাগলো পানির সাথে আর ভোজবাজির মত পাল্টাতে লাগলো রং। কৌতুহলী সম্রাট শেন নাং ভাবলেন, এ নির্যাসও একবার পান করে নেওয়া যাক। যেই ভাবা সেই কাজ, নির্যাস মিশ্রিত পানি পান করার পর নিজেকে অন্যদিনের চাইতে বেশি চনমনে লাগলো তার। ঘুম ঘুম ভাব কেটে গেলো, ক্লান্তি দূর হলো আর সম্রাট ও নতুন স্বাদ পেয়ে খুশী। এরপর অনেক খুঁজে টুজে পাওয়া গেল পাতাটির উৎস।
ক্যামেলিয়া সিনেনসিস গাছ
সেই শুরু থেকে চীনারা করে আসছেন চায়ের পৃষ্ঠপোষকতা, এক চীনা মনীষী লাওৎ সে চা-কে বলেছেন মহৌষধি বা পরশমনি। প্রাচীন চীনারাতো এও ‘চায়ের মত এমন প্রাকৃতিক সুঘ্রাণ আর কিছুতেই নেই।’ আর এ কথার জের ধরেই হয়তো আজ নির্যাসে তৈরি হয়েছে মোহময় বিভিন্ন সুগন্ধি চা। চীনে চা পানের প্রচলন শুরু হয় ঔষধ সেবন হিসেবে। ইংল্যান্ডে নামকরা চায়ের ব্রান্ড হলো ‘টাইফু’ চীনা ভাষায় যার অর্থ চিকিৎসক ‘চা’ নামক এই অতি পরিচিত পানীয়টিতে রয়েছে ৭% থিও ফাইলিন ও থিও ব্রোমিন যা শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানির জন্য অনেক উপকারী। এতে রয়েছে ২৫% এরও বেশি পলিফেনলস, যা ক্যান্সার প্রতিরোধী। ৮০০ খ্রীস্টাব্দে জাপানে চা পানের অভ্যাস ও চালু হয় মূলত স্বাস্থ্য রক্ষার জন্যই। চীনের সিচুয়ান প্রদেশের লোকেরা সর্ব প্রথম চা সেদ্ধ করে ঘন লিকার তৈরী করতে শেখে। ১৬১০ সালে ইউরোপে চায়ের প্রবেশ ঘটে পর্তুগীজদের হাত ধরে এবং ১৬৫০ সালে চীনে বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু করে। চা উৎপাদনে ও প্রচলনে ঈর্ষান্বিত হয় ইংরেজরা। ১৭০০ সালের দিকে ব্রিটেনে চা জনপ্রিয়তা পায় এবং এদের মাধ্যমেই ভারতীয় উপমহাদেশে চায়ের প্রবেশ ঘটে। চা পানের অভ্যাস জন্ম দেয় দুটি বাণিজ্যিক ত্রিভুজে। চিনির জন্য ব্রিটেন-আফ্রিকা।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং চা পাতার জন্য ব্রিটেন চীন ভারত। প্রথম দিকটায় ঝোঁকের বশে ইংরেজরা সোনার বিনিময়ে চীনের কাছ থেকে চা আমদানি করে এবং এতে করে ইংল্যান্ডের ব্যাপক আর্থিক ক্ষতি সাধিত হয়। এই ক্ষতি রোধ করতে ব্রিটিশ সরকার তাদের কোম্পানির মাধ্যমে ভারতে আফিম চাষ করে এবং চীনকে বাধ্য করে এই আফিমের বিনিময়ে চা রপ্তানী করতে। যে আজ ভারতীয় উপমহাদেশের প্রায় প্রতিটি গৃহে অতিথিকে করতে চাওয়া আপ্যায়ন, সে চা কে কিন্তু ভারতবর্ষে অতিথি হয়ে প্রবেশ করতে পোহাতে হয়েছে অনেক ভোগান্তি। সে সময়ের অন্যান্য সকল নতুন বিষয়ের মতই ১৮১৮ সালে চা কেও ভারত বর্ষে পৌঁছে দেয় ব্রিটিশরাই। ছোট ছোট দোকান খোলার উদ্দেশ্যে নামমাত্র মূল্যে বাকিতে এবং সর্বোপরি বিনামূল্যে পর্যন্ত চা সরবরাহ করেছে ব্রিটিশ কোম্পানীগুলো। ব্রিটিশরা চেয়েছিলো এদেশের মানুষের মর্মে চা কে প্রবেশ করাতে , তাদেরকে চা তে অভ্যস্ত করে তুলতে—- যাতে করে তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের তালিকায় চা স্থান পায় এবং তাদের নিয়মিত চায়ের খদ্দের জোটে। কিন্তু চা কে এদেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য বা জনপ্রিয় করে তুলতে বোধ করি এত সহজতর ছিলো না। বিজ্ঞাপনের পর বিজ্ঞাপন একে করেছে সহজতর ও পরিচিত। প্রথম চা কোম্পানী ‘অসম চা কোম্পানী’ প্রতিষ্ঠার পরপরই ইংরেজরা এর আনুষ্ঠানিক বিজ্ঞাপনে জোর দেয়। প্রথম কাজ ছিল বিশেষজ্ঞদের নিয়ে চায়ের বিজ্ঞানসম্মত উপকারিতা বের করা। তারপর এর সাথে আকর্ষণীয় ভাষার মিশেলে বিজ্ঞাপন তৈরী।
১৮৫৫ সালে ব্রিটিশরা সর্বপ্রথম চায়ের গাছ খুঁজে পায় সিলেটে। এরপর ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনীছড়া চা বাগানে শুরু হয় বাণিজ্যিক চা চাষ। পৃথিবীতে দুই ধরণের চা গাছ দেখতে পাওয়া গিয়েছে। চীন জাতীয় চা গাছ ও আসাম জাতীয় চা গাছ। চীন জাতীয় চা গাছ আকারে ছোট হয় এবং আসাম জাতীয় চা গাছ আকারে প্রায় একই রকম হতে গাছের পাতা স্বাদ ও গন্ধের জন্য বিখ্যাত। এই দুধরণের চা পাতার উন্নত সংমিশ্রনের ওপরই এর গুণাগুণ নির্ভর করে। চা থেকে পাতা সংগ্রহ করবার জন্য আপনাকে অবশ্যই দুটি পাতা ও একটি কুঁড়ি একসাথে তুলতে হবে, তা না হলে সে চায়ের আমেজটাই নষ্ট হয়ে যাবে। এই বৈশিষ্টের জন্যই চায়ের লীলাভূমি সিলেটকে বলা হয় দু’টি পাতা ও একটি কুঁড়ির দেশ। চীন-জাপানে বছরে গড়পড়তা তিনবার চা-পাতা সংগ্রহ করা হয়। কিন্তু ভারত-বাংলাদেশ, শ্রীলংকায় ঘন ঘন পাতা সংগ্রহ করা হয়। এদেশগুলোতে বছরে গড়ে ষোলো বা বিশবার পর্যন্ত চা-পাতা সংগ্রহ করতে দেখা যায়। চা মূলত ‘ক্যামেলিয়া সিনেনসিম’ নামক উদ্ভিদটির পাতা পর্ব ও মুকুলের কৃষিজাত পণ্য। চা মৌসুমী অঞ্চলের পার্বত্য ও উচ্চভূমির ফসল, গ্রীকদেবী থিয়ার নামানুসারে নাম রাখা হয়েছিলো ‘টি-টি থেকে চীনে চি এবং আমরা বলি ‘চা’। প্রস্তুতের প্রক্রিয়া অনুযায়ী চা ৫ ধরনের হয়ে থাকে। কালো চা, সবুজ চা, ইষ্টিক চা, উলং চা ও প্যারাগুয়ে চা।
চা প্রস্তুতিকে আরো সহজ করে তুলতে ১৯০৯ সালে টমাস সুলেভ্যান টি ব্যাগের প্রবর্তন করেন। যে ধরণের চা-ই হোক ভারতের পুরনো সেই বিজ্ঞাপনের সুরেই বলা যায়— আপনার দিন শুরু এক কাপ আপনার নিজস্ব স্বাদের চা নিয়ে, চাইলে বলতে পানি সুমনের সেই গানের মতই এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই। নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ুন আহমদও চায়ের স্তুতি করেছিলেন তার উষ্ণতার মাপকাঠিতে, এক কাপ উষ্ণ চা একজন ভালো বন্ধুর মত, বলে স্বাদে হোক, গন্ধে হোক, উষ্ণতায়ই হোক, চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠুক, বলা যায় শত তর্কের ঝড় চায়ের স্টলে বন্ধুর হাতে।