নিউজ ডেস্কঃ
বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় স্থান পেয়েছেন অদম্য মেধাবী শোভা রানী
পাওলো কোয়েলহোর ‘দ্যা আলকেমিস্ট’ বইয়ে একটা কথা আছে, ‘কেউ যখন কোনো কিছু খুব করে চায় তখন চারপাশের সবকিছুই তার চাওয়া পূরণ করতে চায়।’ যেন এমনটাই ঘটেছে শোভা রানীর জীবনে। মানুষের বড় কিছু করার জন্য ইচ্ছাশক্তিই যে সবচেয়ে বেশি দরকার, তারই প্রমাণ দিয়েছেন ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ার মেয়ে শোভা রানী। নানা ঘাত-প্রতিঘাতের কারণে বারবার যে মেয়েটির পড়ালেখা বন্ধের উপক্রম হয়েছিল, সেই মেয়েটিই এবার বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় মেধাতালিকায় স্থান পেয়ে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। অদম্য মেধাবী এই মেয়েটি এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সকলের প্রশংসায় ভাসছেন। উঠে এসেছে তার বেড়ে ওঠার গল্প।
জন্মের আগেই বাবাকে হারিয়েছেন শোভা রানী। শোভা যখন মায়ের পেটে, তখন নিখোঁজ হয়ে যান তার বাবা। পরে জানা যায় তিনি মারা গেছেন। মা প্রতিমা রানী দাশ আশ্রয় নেন ভাইয়ের বাড়িতে। সেখানেই বড় হচ্ছিলেন শোভা। কিন্তু মা যে মেয়েকে পড়াতে চান, এই বিষয়টির পক্ষপাতী ছিলেন না মামারা। তারা চাইতেন, ‘অযথা’ যেন এই মেয়ের পেছনে বাড়তি খরচ না হয়। ফলে ভাইয়ের বাড়িতেও বেশিদিন স্থায়ী হওয়া হয়নি প্রতিমার।
প্রতিমা রানী দ্বিতীয়বার বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন শোভার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই। কিন্তু বিধিবাম। এই সংসারে এসে মাদকাসক্ত স্বামীর নির্যাতনের শিকার হতে হয় তাকে। এতকিছুর পরেও মেয়ের জন্য তিনি পরিশ্রম করে গেছেন। কখনো গৃহপরিচারিকার কাজ, কখনোবা যৎসামান্য পারিশ্রমিকে আচার আর চকলেট বানিয়েছেন। আচারের এক হাজার প্যাকেট বানালে ৩০ টাকা করে পেতেন। এভাবে দু’বেলা খাবার আর শোভা ছোটবেলার স্কুলে পড়ার খরচ উঠে আসতো। মেয়েকে নিয়েই ছিল তার সব স্বপ্ন। মায়ের সঙ্গে নানা চড়াই-উতরাই পেরোতে হয় ছোট শোভাকে। তবে পরিশ্রম আর ইচ্ছাশক্তির জোরে হার মেনেছে সব বাধাবিপত্তি।
মাত্র সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই শোভা রানীকে রোজগারের পথ খুঁজতে হয়েছিল। ফলে সেসময় টিউশনি শুরু করেন। মন দিয়ে পড়তেন, আর অন্যকে পড়াতে গিয়ে পড়াশোনার চর্চাটা আরও ভালো করে হতো। অন্যদিকে উপার্জিত টাকা দিয়ে ঘর চলত, চলত স্কুলের বেতন। এরইমাঝে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় হঠাৎ তার পড়ালেখা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
‘পড়াশোনায় সৎবাবার সমর্থন ছিল না। নবম শ্রেণিতে থাকাকালেই তিনি আমাকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন’—জানান শোভা। তখন এগিয়ে আসেন স্থানীয় কোচিং সেন্টারের শিক্ষকরা। কখনো বিনা বেতনে, কখনো নামেমাত্র বেতনে পড়িয়েছেন তারা।
এদিকে এসএসসি’র পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষার আগের রাতে মায়ের সাথে ঝগড়া হওয়ায় শোভাকে বাসা থেকে বের করে দেন সৎবাবা। শোভা পড়তে পারেন নি সে রাতে। তবুও সেই পদার্থবিজ্ঞান পরীক্ষায় ৯৮ সহ সব বিষয়ে গড়ে প্রায় ৯৮ শতাংশের বেশি নম্বর পেয়ে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। ফলাফল দেখে পাশে এসে দাঁড়ায় প্রথম আলো ট্রাস্ট। এরপর ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক সম্পন্ন করেন তিনি।
এইচএসসি তো গেল, তারপর ভর্তি পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি। স্বপ্ন ছিল প্রকৌশলে পড়বেন। কিন্তু কোচিংয়ে ভর্তি হবেন কীভাবে, এ নিয়ে রয়ে গেল অনিশ্চয়তা। একদিন এক বান্ধবীর কাছ থেকে ঘুড্ডি ফাউন্ডেশনের ভর্তি কোচিং বৃত্তির কথা জানতে পারলেন শোভা রানী। কিন্তু এই বৃত্তি পাওয়ার জন্য একটি পরীক্ষায় অংশ নিতে হবে। সেই পরীক্ষায় ভালো করলেই কেবল পাওয়া যাবে কোচিং ফি ও থাকা-খাওয়ার খরচ।
সেই পরীক্ষায়ও ভালো ফলাফল করেন শোভা। হোস্টেলে থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তির জন্য পড়াশোনা করার সুযোগ পেলেন। ‘উচ্চমাধ্যমিকের পড়াশোনা আর ভর্তি পরীক্ষার পড়াশোনা সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের। ভর্তি পরীক্ষার জন্য কোচিং করাটা খুব দরকারি ছিল। ঘুড্ডি ফাউন্ডেশনের বৃত্তিটি না পেলে কোচিং করাই হত না সেক্ষেত্রে’—জানান শোভা।
পরবর্তীতে ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম পূরণ ও যাতায়াতের খরচ বহন করে ‘মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’। এরপর ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে শোভা দেখান দারুণ চমক। বুয়েটে ৭২২তম হওয়ার পাশাপাশি ঢাবি ক ইউনিটে ১০৯তম, জাবি এ এবং এইচ—দুই ইউনিটেই ১৯তম, রাবিতে সি ইউনিটে ৩য়, বুটেক্সে ৩৬৫তম এবং গুচ্ছ ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ৮৮৬তম হয়েছেন শোভা।
এত এত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও মায়ের প্রেরণাই ছিল শোভার একমাত্র সম্বল। শোভার মতে, ‘যখনই কোনো বাধা এসেছে, আমি চেষ্টা করেছি মায়ের মুখটা মনে করার। আমি ভালো কিছু করলে মায়ের হাসিমুখটাই আমাকে প্রেরণা দিয়েছে পরবর্তীতে আরো ভালো কিছু করার।’
শোভা বলেন, ‘পড়ালেখা বন্ধের উপক্রম হয়েছে অনেকবার। কাল স্কুলে যেতে পারব কিনা তার নিশ্চয়তা নেই, এমনও দিন গেছে। কিন্তু মায়ের কথা ভেবেই পড়ালেখা চালিয়ে গেছি।’
অভাবের পাশাপাশি অসুস্থতা ছিল শোভার মায়ের নিত্যদিনের সঙ্গী। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রোগে পড়েছেন তিনি। মায়ের অসুস্থতার চিকিৎসা কখনো কখনো হয়েছে শোভার টিউশনির টাকায়, কখনো দিন কাটাতে হয়েছে চিকিৎসা ছাড়াই। মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এবার শোভার মায়ের চিকিৎসায় সহযোগিতা করার দায়িত্ব নিয়েছে। শোভা জানান, তিনি বুয়েটে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। পূর্বের ফলাফলের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে এগিয়ে যেতে চান তিনি। এই পর্যন্ত আসার পেছেন যারা আর্থিকভাবে ও মানসিকভাবে সাহায্য করেছেন তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
শোভা রানীর এতদূর আসার পেছনের গল্পটা ঠিক যেন সিনেমার মত। যে পরিমাণ সংগ্রাম তাকে করতে হয়েছে, আর আট-দশজনের পক্ষে হয়তো তা সম্ভব হতো না। নিজের ইচ্ছাশক্তি, ধৈর্য আর পরিশ্রমের মিশেলে তিনি পৌঁছে গেছে স্বপ্নের দ্বারপ্রান্তে।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।