ডেস্ক রিপোর্ট: ফ্রান্সের জনগণ আবারও জানিয়ে দিলো যে, তারা কট্টর ডানপন্থীদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতায় দেখতে চায় না। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের নির্বাচনে বড় জয় পেয়েছিল ডানপন্থীরা। এমনকি, ফ্রান্সের পার্লামেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রেও প্রথম দফায় এগিয়ে ছিল তারা। কিন্তু রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যে নির্বাচনে বিজয় নিশ্চিত করাটা সবচেয়ে বেশি জরুরি ছিল, সেখানেই পিছিয়ে পড়লো কট্টর ডানপন্থীরা। ফ্রান্সের দ্বিতীয় ধাপের পার্লামেন্ট নির্বাচনের ফলাফলে দেখা যাচ্ছে যে, দেশটির কট্টর ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল র্যালি (আরএন) সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি তারা দ্বিতীয় অবস্থানেও নেই। দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে নাটকীয়ভাবে জয় পেয়েছে বামপন্থী দলগুলোর জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনপিই)। আর তাদের পরেই দ্বিতীয় অবস্থানে দেখা যাচ্ছে, ফ্রান্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাখোঁর মধ্যপন্থী দলকে। এর আগে, প্রথম দফার নির্বাচনে প্রায় ৩৩ শতাংশ ভোট নিয়ে এগিয়ে ছিল ন্যাশনাল র্যালি (এনআর)। এর বিপরীতে, ২৮ শতাংশ ভোট নিয়ে ফ্রান্সের বামপন্থী জোট নিউ পপুলার ফ্রন্ট (এনপিএফ) দ্বিতীয় অবস্থানে এবং প্রায় ২১ শতাংশ ভোট পেয়ে তৃতীয় অবস্থানে ছিল মি. ম্যাখোঁর নেতৃত্বাধীন অনসম্বল অ্যালায়েন্স। এমতাবস্থায় ডানপন্থীদের ঠেকাতে ফ্রান্সের মধ্যপন্থী ও বামপন্থী দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ। এরপর আপসের ভিত্তিতে বাম ও মধ্যপন্থী দলগুলোর প্রার্থীদের অনেকেই একে অন্যকে একাধিক আসন ছেড়ে দেন। আর এর ফলেই ডানপন্থীরা পিছিয়ে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এরপর ১৬৮টি আসন পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে মধ্যপন্থী জোট অনসম্বল অ্যালায়েন্স। আর কট্টর ডানপন্থী ন্যাশনাল র্যালি জয় পেয়েছে ১৪৩টি আসনে। বুথ-ফেরত জরিপের ফল আসার পর বাম জোটের অন্যতম শরিক দল সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা অলিভিয়ের ফাউরে বলেছেন, ‘ফ্রান্স বলেছে, ন্যাশনাল র্যালিকে ক্ষমতায় যেতে দেওয়া হবে না। কারণ এখানে নিউ পপুলার ফ্রন্টের জয় নিশ্চিত হয়েছে’।
এদিকে, নির্বাচনে পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে ফ্রান্সের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী গ্যাব্রিয়েল আতাল পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। দু-এক দিনের মধ্যেই তিনি পদত্যাগপত্র জমা দিতে পারেন বলে জানা যাচ্ছে। অন্যদিকে, ডানপন্থী দল ন্যাশনাল র্যালির নেতা মারি লা পেন বলেছেন, এবারের নির্বাচনের ফলাফলের মধ্যে তিনি আগামী দিনের বিজয়ের বীজ দেখতে পাচ্ছেন। দলটির আরেকজন নেতা জর্ডান বারডেলা বাম ও মধ্যপন্থীদের ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘অস্বাভাবিক’ এবং ‘মর্যাদাহীন’ জোট ফ্রান্সের জনগণকে ‘ন্যাশনাল র্যালির বিজয়’ থেকে বঞ্চিত করেছে। দ্বিতীয় দফার এই নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিশ্চিত করতে পারলে জর্ডান বারডেলা ফ্রান্সের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন বলে শোনা যাচ্ছিলো। প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাখোঁ গত নয়ই জুন আগাম নির্বাচন ঘোষণা করার পর সোশ্যালিস্ট (সমাজতান্ত্রিক), পরিবেশবাদী, কমিউনিস্ট ও কট্টর বামপন্থী দল ফ্রান্স আনবোয়েড পার্টি (এলএফআই) মিলে নতুন যে জোটটি গড়ে তোলেন, সেটিই নিউ পপুলার ফ্রন্ট নামে পরিচিতি পায়। এসব দল আগে একে অপরের সমালোচনা করত এবং তাদের আদর্শ ও কর্মপদ্ধতির মধ্যেও বেশ ব্যবধান রয়েছে। তারপরও তারা জোট গঠন করেছে যেন কট্টর ডানপন্থীরা কোনোভাবেই রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে না পারে।
বস্তুত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কট্টর ডানপন্থী কোনো দল ফ্রান্সের রাষ্ট্র ক্ষমতায় বসতে পারেনি। নিউ পপুলার ফ্রন্টের পক্ষ থেকে বর্তমান সরকারের পাশ করা পেনশন ও অভিবাসন বিষয়ক সংশোধিত আইন বাতিলের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে অবৈধ অভিবাসীদের ব্যবস্থাপনা এবং ভিসা আবেদনের বন্দোবস্ত করার জন্য একটি সহায়তাকারী সংস্থা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জীবনযাপনের ব্যয় কমানোর লক্ষ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম নির্ধারণ করা এবং ন্যূনতম বেতন বাড়ানোরও ঘোষণাও দিয়েছে বামপন্থীদের নতুন এই জোট। খবরে বলা হয়, কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। এর জন্য অস্বাভাবিক রাজনৈতিক জোটকে দায়ী করেছেন ন্যাশনাল র্যালি দলটির ২৮ বছর বয়সী প্রেসিডেন্ট জর্ডান বারডেলা। মাত্র সাত মাস আগে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছেন গাব্রিয়েল আতাল। তিনি দলের পরাজয়ে ঘোষণা দিয়েছেন যে, সোমবার সকালে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন। শেষ দিকে রাজনৈতিক কৌশলে প্রার্থীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের পর তিনি দাবি করেছিলেন, ন্যাশনাল র্যালি যে আসন পাবে বলে বলা হয়েছে, তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি পাবে। ম্যাখোঁ এবং বামপন্থিদের জোট এনসেমবল থেকে ২১৭ জন প্রার্থী প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেয়ার পর তিনি এমন ঘোষণা দেন। তবে তাদের কৌশল কাজে দিয়েছে। মেরি লা পেনের দলকে তৃতীয় অবস্থানে নামাতে পেরেছে। কিন্তু নিজেরা এক নম্বরে উঠতে পারেনি। জর্ডান বারডেলার অভিযোগ, ফ্রান্সে জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির ফলে ক্ষুব্ধ মানুষকে তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। এভাবে লাখ লাখ ভোটারকে বঞ্চিত করার জন্য অসম্মানজনক জোটের নিন্দা জানান। তিনি বলেন, আমরা ক্ষমতা হাতে চাই না। আমরা ক্ষমতা জনগণের হাতে তুলে দিতে চাই। বামপন্থিদের জোটের বিজয়ের জন্য ম্যাক্রনের জোটকে দায়ী করেছেন দলটিতে বারডেলার সহকর্মী সেবাস্তিয়েন সেনু। তিনি বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ফ্রান্সকে এক গোলকধাঁধায় ফেলেছেন। ফ্রান্স এখন ঝুলন্ত পার্লামেন্টের দিকে যাচ্ছে এটা নিশ্চিত। এর অর্থ হলো দেশটি অনিশ্চিত এক অবস্থায় পতিত হবে। কারণ, বামপন্থি জোটের নেতৃত্বে আছেন আরেক উগ্রপন্থি জ্যাঁ-লুক মেলেঞ্চন।
সূত্র : সিএনএন, বিবিসি বাংলা, এএফপি।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।