জাহাঙ্গীর হোসেন জুয়েল,কুষ্টিয়া প্রতিনিধি :: আলোচিত শিশু দেব দত্ত হত্যার এক বছর পূর্ণ হলেও প্রধান দুই খুনী এখনও আটক হয়নি। অপহরণের পর নৃশংসভাবে হত্যার শিকার স্কুলছাত্র শিশু দেব দত্ত (১০) মামলায় ৫ জনকে আসামি করে কুষ্টিয়া আদালতে চার্জশিট দাখিল করেছে মিরপুর থানার ওসি (তদন্ত) আব্দুল আলিম। এক বছরেও আলোচিত হত্যা মামলার প্রধান দুই আসামি আটক না হওয়ায় ভুক্তভোগী পরিবার ও এলাকাবাসীর মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।
মিরপুর থানার ওসি (তদন্ত) আব্দুল আলিম জানান, পলাতক আসামি গ্রেফতারে ইন্টারপোলসহ পুলিশি তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। চার্জশিটভুক্ত আসামিরা হলো কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার চিথলিয়া ইউপি’র চিথলিয়া গ্রামের মালিথা পাড়ার আনছার আলীর ছেলে এরশাদ আলী (২২), একই পাড়ার আমান আলী মুন্সীর ছেলে হাবিবুর রহমান ওরফে হাব্বুল (৩৩), তুফান মল্লিকের ছেলে সবুজ (২৩), আক্কাস আলীর ছেলে জোয়ার হোসেন (২৩) ও জহুরুল ইসলামের ছেলে নাঈম ইসলাম (২২)। এর মধ্যে জোয়ার হোসেন ও নাঈম ইসলাম পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। সবুজ বর্তমানে কুষ্টিয়া জেল হাজতে এবং হাবিবুর রহমান ওরফে হাব্বুল ও এরশাদ আলী পলাতক রয়েছে।
পিতা পবিত্র দত্ত জানান, প্রধান দুই আসামি এরশাদ আলী এবং একই পাড়ার হাবিবুর রহমান ওরফে হাব্বুল পালিয়ে ভারতে অবস্থান করছে। দুই আসামিকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য ২০১৮ সালের ২ জুলাই ভারতীয় হাই কমিশনারের কাছে লিখিতভাবে আবেদন করেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে ব্যাপারে ইতিবাচক কোন সাড়া মেলেনি।
পরিবার ও পুলিশ জানায়, ২০১৮ সালের ৯ জুন সকালে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার চিথলিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির মেধাবী ছাত্র দেব দত্ত (১০) সকাল সাড়ে ৭টায় বাড়ীর পাশে তালিম মাষ্টারের বাড়িতে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় তাকে অপহরণ করে ৫০লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে অপহরণকারীরা। দেব উপজেলার চিথলিয়া গ্রামের ধুবইল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পবিত্র দত্তের একমাত্র পুত্র সন্তান।
চার্জশিট সূত্রে লোমহর্ষক আলোচিত দেব দত্ত হত্যাকান্ডের ঘটনাটি প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ঘটনার এক মাস পূর্বে প্রতিবেশি আক্কাস আলীর ছেলে হত্যার মূল পরিকল্পনাকারি জোয়ার ও আমান আলী মুন্সীর ছেলে হাবিবুর রহমান ওরফে হাব্বুল দেব দত্তের সাথে মোবাইলে ভিডিও গেম খেলা ও ফাষ্ট ফুডের বিভিন্ন খাবার দিয়ে তার সাথে সখ্যতা গড়ে তোলে। এরপর পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের ৯ জুন সকাল সাড়ে ৭টায় দেব প্রাইভেট পড়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বের হলে আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা হাবিবুর তার নিজের মোটরসাইকেলে হেলমেট পড়ে বসেছিল এবং জোয়ার হেলমেট পড়ে দেবকে মোটরসাইকেলের মাঝখানে তুলে নিয়ে যায় ৪’শ গজ দূরে হাবিবুরের নিজ বাড়িতে। পরের ঘটনাটি আদিমযুগের বর্বরতাকেও হার মানায়। ৯ বছরের শিশু দেব যখন একটা অস্বাভাবিক অবস্থা বুঝতে পারছিল তখন সে জোয়ারকে বলছিল কাকু আমিতো পড়তে যাবো। আমাকে ছেড়ে দাও। কিন্তু তার আর্তনাদের একটা শব্দও তাদের মনে কোন দাগ কাটেনি। দেবকে হাবিবুরের শয়ন কক্ষে প্রবেশ করিয়ে কিলিং মিশনের হাবিবুর, জোয়ার, এরশাদ, নাঈম ও সবুজ শলা পরামর্শ শেষে ঘটনার আধ ঘন্টার মধ্যে জোয়ার, নাঈম ও সবুজ ঘরের মধ্যে ঢুকে দেবের হাত পা নাক মুখ চেপে ধরে তাকে শ্বাসরোধ হত্যা করে। এসময়ে হাবিবুর ও এরশাদ রাস্তায় টহল দিচ্ছিল। লাশটি গুম করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ওইদিনই সকাল ১০টায় দেবের নিথর দেহ বস্তাবন্দি করে আমের কাটুনে মধ্যে ঢুকিয়ে পার্শ্ববর্তী নাঈমের বাড়িতে নিয়ে যায়। এবং তার (নাঈম) বাড়ির শৌচাগারে সাপ দেখা গিয়েছে গল্প বানিয়ে নাঈম, সবুজ ও হাবিবুর তিনজনে মিলে এর পাশেই আরেকটি কুয়ো খোঁড়ে। এরপর আগের কুয়োটির মধ্যে দেবের বস্তাবন্দি লাশটি রেখে দিয়ে মাটিচাপা দেয়। এসময়ের মধ্যে এরশাদ ও জোয়ার মিরপুর উপজেলার নিমতলা বাজারের টাওয়ারের লোকেশনে এসে দেবের বাবা পবিত্র দত্তের কাছে মোবাইল করে ৫০লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করার কিছুক্ষণ পরেই কিলার জোয়ার দেবের পরিবারের সকলের সাথে দেখা করে তাদের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা করে।
ঘটনার পর মিরপুর থানা পুলিশ ও স্থানীয়রা দেবকে উদ্ধারে ব্যাপক তৎপর হয়ে উঠে। মোবাইল নম্বরের সূত্র ধরেই ১১ জুন দুপুরে সিমটির মালিক চিথলিয়ার জুয়েলকে আটক করে থানা পুলিশ। অপহৃত উদ্ধার তৎপরতায় নিয়োজিত তৎকালিন মিরপুর-ভেড়ামারা সার্কেলের এএসপি নূর ই আলম সিদ্দিকীর ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদে জুয়েল জানায় মোবাইল সেটসহ তার সিমটি চিথলিয়ার হাট থেকে হারিয়ে যায়। পুলিশি ব্যাপক অনুসন্ধান ও দেব পরিবারের সন্দেহের ভিত্তিতে হত্যার মাষ্টারমাইন্ড জোয়ারকে আটক করে স্থানীয় থানা পুলিশ।
এরমধ্যেই দেবকে উদ্ধারের দাবিতে মিরপুরসহ কুষ্টিয়া জেলার সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রতিবাদে ফুঁসে উঠে। শুরু হয় মানববন্ধন সহ বিভিন্ন কর্মসূচি। যার ফলে গোটা কুষ্টিয়ার পুলিশ প্রশাসন ব্যাপক অভিযান চালিয়ে ২০১৮ সালের ২৫ জুন দুপুর দেড়টায় কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সাখাওয়াত হোসেনের নের্তৃত্বে নাঈমের বাড়ির শৌচাগারের ৪/৫ ফুট গভীরের কুয়ার মধ্য থেকে দেবের বস্তাবন্দি গলিত লাশ উদ্ধার করে।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।