কুষ্টিয়া লালন স্মরণোৎসবের সাধুসঙ্গ শেষ ॥ অনুষ্ঠান মালা চলবে

Daily Ajker Sylhet

০৯ মার্চ ২০২০, ০৭:৪৩ পূর্বাহ্ণ


কুষ্টিয়া লালন স্মরণোৎসবের সাধুসঙ্গ শেষ ॥ অনুষ্ঠান মালা চলবে

 

জাহাঙ্গীর হোসেন জুয়েল কুষ্টিয়া প্রতিনিধি ॥
কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন মাজারের সোমবার (৯ মার্চ) দুপুর আড়াই টায় মাজারে প্রায় সাত হাজার বাউল-ফকির, সাধু-ভক্ত পুণ্যসেবা গ্রহণ করেন। এই পুণ্যসেবার মধ্য দিয়ে লালন স্মরণোৎসবের সাধুসঙ্গ শেষ হলো। এরপর সাধুরা চলে যাবেন যে যার গন্তব্যে। লালন স্মরণোৎসবের সাধুসঙ্গ শেষ হলোও মঙ্গলবার গভীর রাত পর্ষন্ত চলবে অনুষ্ঠান। এর আগে রোববার রাতে রাখাল সেবার (মুড়ি) মধ্য দিয়ে দৌলপূর্ণিমার উৎসব ও সাধুসঙ্গ শুরু হয়।
সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে লালন একাডেমির প্রধান ফটক বন্ধ। ভেতরে সারিবদ্ধভাবে বসে আছেন হাজারো বাউল-ফকির ও সাধু-ভক্ত। সবার সামনে কলাপাতায় পরিবেশন করা হয়েছে খাবার, যার নাম পুণ্যসেবা। কলাপাতায় রয়েছে সাদাভাত, ত্রিব্যঞ্জন (তিন ধরনের সবজি), ডাল, ইলিশ মাছ ও দই।
কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় লালন মাজারের খাদেম ফকির মোহাম্মদ আলী জানান, বাউলের চারণভূমিতে আসা হাজার হাজার লালন-ভক্ত, সাধু-গুরুদের সোমবার সকালে বাল্যসেবা (পায়েশ ও মুড়ি) দেওয়া হয়েছে। এরপর দুপুরে মরা কালীগঙ্গায় গোসল সেরে ইলিশ মাছ-ভাত ও ত্রিব্যঞ্জন দিয়ে পুণ্যসেবা দেওয়া হয়। দাওয়াত ছাড়াই এখানে মানুষ ছুটে আসেন দলে দলে, হাজারে হাজারে। আবারও সাধুরা ফিরে আসবেন সাঁইজির তিরোধান দিবসে।
লালন একাডেমির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সেলিম হক জানান, এবারে পুণ্যসেবায় ৫০০ কেজি ইলিশ মাছ, ৫০ মণ চাল, ২০০ কেজি ডাল, ২০ মণ সবজি ও ১৩ মণ দই দিয়ে প্রায় ৭ হাজার সাধুভক্তদের আপ্যায়ন করা হয়েছে।
রবিবার রাতে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ছেঁউড়িয়ার লালন আখড়াবাড়িতে দোল পূর্ণিমার রাতে আনুষ্ঠানিভাবে স্মরণোৎসবের উদ্বোধনের পর মঞ্চে ওঠেন এই প্রবীণ শিল্পীরা। গেয়ে শোনান ডুবাইয়ে ভাসাইতে পারো, ভাসাইয়ে কি! সমবেত কন্ঠে গেয়ে ওঠেন দরাজ গলায় এমন লালন সঙ্গীত।
কুষ্টিয়ার দরবেশ নহীর শাহ, মহরম শাহ, সামসুল ফকির, রওশন ফকির, হৃদয় শাহ, রাজ্জাক বাউল, এনামুল শাহ, আরিফ বাউল, গোলাপি, ছমির বাউল, পাগলা বাবলু, তকাবর বাউলসহ অন্তত ১৫ জন প্রবীণ শিল্পীর কন্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে লালনের এই অমীয় বাণী। পরে কাঙালিনী সুফিয়াসহ লালন একাডেমির শিল্পীদের পরিবেশনায় রাতভর চলে এ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
হোসেন জানান, কাঙ্গালিনী সুফিয়ার গান আমরা ছোটবেলা থেকে শুনেছি। কিন্তু কখনো তাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়নি৷ এবারের লালনের এই মেলায় এসে খুব কাছ থেকে তার গান শুনেছি। অনেক অনেক ভালো লেগেছে। এছাড়াও প্রবীণ শিল্পীদের সমন্বয়ে পরিবেশিত গান উপভোগ করলাম, তা সত্যিই অসাধারণ। লালনের বাণী যে এত সুন্দর ও সুমধুর হয় তা খুব কাছ থেকে এই লালনসঙ্গীত না শুনলে বুঝতেই পারতাম না।
শিক্ষার্থী হুমায়ন বলেন, লালনের গানের অনেক মর্ম কথা শুনেছি। তার বাণীর কথা শুনেছি। কিন্তু লালনের এই ধামে কখনো আসা হয়নি। এবারই প্রথম আসলাম। এত সুন্দর করে তাদের পরিবেশন করা গান খুবই ভালো লাগলো। আবারও আসবো এই ধামে।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এমপি বলেছেন, আমার প্রথম আসা এই বাউল আখড়াবাড়িতে। এসেই বুঝলাম এই মহাজ্ঞানী লালনের সৃষ্টির কৃর্তি আজ আর কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ীর মধ্যে আবদ্ধ নেই। লালন সাঁইয়ের সৃষ্টি বিশ্বে সর্বাজনীন হয়ে উঠেছে। মানব সেবার ব্রত নিয়ে অসংখ্য গান লিখে গেছেন। তাঁর এই অমর সৃষ্টি সঙ্গীত কোন ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এদিকে যেমন তাঁর সৃষ্টি ছড়িয়েছে বিশ্বে তেমনি তাঁকে নিয়ে হচ্ছে উন্নতর গবেষনা। লালন সাঁই জাত-ধর্মের সীমাবদ্ধতার বাইরে মানুষকে সবার উপর তুলে ধরেছেন। লালন সাঁইয়ের বাউল মতবাদ আজ বিশ্বে সর্বাজনীন হয়ে উঠেছে। বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের স্মরণোৎসবে আত্মসুধ্যির উদাসীর টানে দেশ-বিদেশের বাউল-ফকিরবৃন্দরা ছুটে আসে এই আখড়া বাড়ীতে। তাঁর আত্মতত্ব মানুষকে শান্তির পথ দেখায়, সুখের সন্ধ্যান দেয় জাগতিক মোহ থেকে রাখে মুক্ত। রবিবার রাতে ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়ীতে লালন একাডেমির আয়োজনে ৩ দিনব্যাপী বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের স্মরণোৎসব (দোলপূর্ণিমা) অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধনী দিনের আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ সব কথা বলেন। উদ্বোধনী দিনে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক আসলাম হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন কুষ্টিয়া-৪ (খোকসা-কুমারখালী) আসনের এমপি ব্যারিষ্টার সেলিম আলতাফ জর্জ, কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান, কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হাজী রবিউল ইসলাম, কুষ্টিয়া জজকোর্টের পিপি এ্যাড.অনুপ কুমার নন্দী, কুষ্টিয়া জজকোর্টের জিপি এ্যাড. আ. স. ম. আখতারুজ্জামান মাসুম, কুষ্টিয়াপ্রেসক্লাবের সভাপতি রাশেদুল ইসলাম বিপ্লব প্রমুখ। অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক হিসেবে আলোচনা করেন ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্জ প্রফেসর ড. শাহিনুর রহমান। লালন সাঁইজির ধ্যান-সাধনা, রচনা ও বাউলতত্ব নিয়ে আলোচক হিসেবে আলোচনা করেন লালন মাজারের খাদেম মোহাম্মদ আলী। শুভেচ্ছ বক্তব্য রাখেন কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ওবাইদুর রহমান। স্বাগত বক্তব্য রাখেন কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসনের এনডিসি ও লালন একাডেমির এ্যাডহক কমিটির সদস্য সচিব মুহাম্মদ মুছাব্বেরুল ইসলাম।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।