‘মানুষ মানুষের জন্য, জীবন জীবনের জন্য’-এ বাক্যটির সাথে সবাই পরিচিত। এমনকি ভূপেন হাজারির সেই কালজয়ী-‘একটু সহানুভূতি কি মানুষ পেতে পারে না…’ এই গান এখনও মানুষের হৃদয়ে নাড়া দিয়ে ওঠে। আমাদের সমাজে কতোই না অপরাধ হচ্ছে। চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি নানা রকম অপরাধের মধ্যেও মানুষের ভেতরে একটি মন রয়েছে। আর এই মনই কোনো এক সময় জেগে উঠে। যা জেগেছিল ১৯৭১ সালে সকল বাঙালির মধ্যে। ঝাঁপিয়ে পড়েছিল শত্রুদের বিরুদ্ধে। ফলে আমরা পাই একটি স্বাধীন দেশ।
এই দেশেই আমাদের মা, এই দেশই আমাদের সব। আর দেশের জন্য যারা সামান্যতম হলেও অবদান রাখতে পারেন তারা সত্যিই দেশপ্রেমিক। আর এমনই একজন ব্যক্তি মাশরাফি বিন মর্তুজা; যাকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।
প্রতিটি দেশের মতো আমাদের বাংলাদেশেরও রয়েছে নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট, তথা ইতিহাস-ঐতিহ্য। এখনও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গা থেকে স্মরণ করা হয় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে এ দেশের লাখ লাখ মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীকে হটিয়ে দেয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই দেশের জন্য যে জেল-জুলুম অত্যাচার সহ্য করেছেন তা তো নিজের সুখের জন্য নয়। এটা তিনি করেছেন এই দেশের সকল মানুষের জন্য। জাতির জন্য। আর তাই তিনি হয়েছেন জাতির পিতা। ঠিক এ ভাবেই প্রত্যেকটি দেশের কিছু না কিছু ইতিহাস থাকে।
যেমন ফুটবলের বিশ্ব তারকা ‘পেলে’র জন্য বিখ্যাত ব্রাজিল, মেরাডোনার জন্য আর্জিন্টিনা। আর এসব কারণেই এ দেশ দু’টির মতো অন্যান্য ক্ষেত্রেও বিভিন্ন দেশ আলোচিত বা পরিচিত। যেমনটি আমাদের বাংলাদেশের জন্যও ক্রিকেট। এই ক্রিকেট খেলার জন্য অনেক দেশের মানুষ বাংলাদেশ-এর নাম জানতে পেরেছে। এর আগে তারা জানতও না যে ‘বাংলাদেশ’ নামের একটি দেশ রয়েছে। আর তা সম্ভব হয়েছে আমাদের বীর সন্তানদের জন্য। যারা মাঠের মধ্যে লড়ে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। এজন্য বিশ্বে আলোচিত মাশরাফি, সাকিব, মুশফিক ও তামিমের মতো তারকরা। তাদের যোগ্য নেতৃত্বেই আমাদের দেশ অনেক সম্মান অর্জন করেছে।
বর্তমানে পৃথিবীতে চরম সংকটময় দিন বিরাজ করছে। প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসের কারণে সবকিছু স্থবির হয়ে পড়েছে। সরকার তো বটেই যে যেভাবে পারে সেভাবেই সাধারণ মানুষকে সহযোগিতা করছেন। এ থেকে পিছিয়ে নেই আমাদের ক্রিকেটাররাও। তারাও ব্যক্তি উদ্যোগে অসহায়দের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তবে এ ক্ষেত্রে মাশরাফি বিন মর্তুজার বিষয়টি ভিন্ন। কারণ তিনি একজন সংসদ সদস্যও। অবশ্য এর আগ থেকেই তার নড়াইল এক্সপ্রেস নামক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে এলাকায় নানা কর্মকা- চালিয়ে আসছেন। এরমধ্যে একজন সংসদ সদস্যর সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী বর্তমানে অসহায় মানষদের জন্য যা করা দরকার তাতো আছেনই, পাশাপাশি তার ব্যবহৃত একটি ব্রেসলেট এখন আলোচনায় এসেছে। এর আগেও অনেক খেলোয়ার নিজেদের ব্যবহৃত জিনিস নিলামে তুলেছেন দু:স্থদের সহায়তার জন্য। তবে তা তেমন আলোচনায় আসেনি। যেমনটি হয়েছে মাশরাফির ক্ষেত্রে। আর এই আলোচনার ‘নায়ক’ বাংলাদেশ লিজিং এ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানিজ এ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসি) চেয়ারম্যান ও আইপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মমিন ইউ ইসলাম।
গল্পটি এরকম-মাশরাফি বিন মর্তুজা হাতে একটি ব্রেসলেট ব্যবহার করতেন। কোভিড-১৯ রোগের প্রকোপের এই দুঃসময়ে অসহায় মানুষের সহায়তার জন্য প্রিয় ব্রেসলেটটি নিলামে তুলেন তিনি, নিজের ভাষায় যেটি তার ‘১৮ বছরের সুখ-দুঃখের সাথী।’ ৫ লাখ টাকা ভিত্তিমূল্যের নিলামে সেটি বিক্রি হয়েছে ৪২ লাখ টাকায়। (বিডিনিউজটুয়েন্টিফোর.কম, ১৮ মে-২০২০)। কিনে নেওয়া সংগঠন বিএলএফসিএর চেয়ারম্যান মমিন ইউ ইসলাম বলছেন, ‘অমূল্য’ এই স্মারক তারা চড়া মূল্যে কিনেছেন মাশরাফির প্রতি সম্মান জানাতেই। তবে এই সম্মান জানানোই শেষ নয়, পরে তিনি যা দেখিয়েছেন তা অনেকটা চমক ও অবিশ্বাস্যও বটে! নিলাম আয়োজনের ফেইসবুক লাইভে তিনি বলেন, এটি দেশের প্রতি মাশরাফির অবদানের সামান্য প্রতিদান।
“আপনি এই দেশকে যে সম্মান এনে দিয়েছেন, সেই সম্মানের প্রতিদান আসলে কোনোভাবেই হয় না। কিন্তু এটুকু করে আমরা চেষ্টা করেছি, আপনাকে কিছুটা হলেও সম্মান জানাতে।” তিনি বলেন, ‘‘মাশরাফির এই স্মারকটি আসলে অমূল্য, কোনো মূল্য হয় না। তার পরও আমরা খুশি যে এই টাকায় ব্রেসলেটটি নিতে পেরেছি।” মমিন ইউ ইসলাম যখন এই কথা বলছেন, মাশরাফি তখন হাত থেকে ব্রেসলেট খুলে তুলে ধরে হাসি মুখে বলছিলেন, “এই যে, খুলে ফেলেছি। এটা আপনাদের, এখন আমার হাত খালি।” এই ‘‘আমার হাত খালি’’ শোনার পরই অবিশ্বাস্য চমক দিলেন মমিন ইউ ইসলাম। বলেন, “এই ব্রেসলেট ১৮ বছর ধরে আপনার সঙ্গে আছে, এটি আপনার হাতেই মানায়। আমরা এই ব্রেসলেট আপনাকেই উপহার দিতে চাই।” মমিন ইউ ইসলাম জানিয়েছেন, সামনেই একটি আয়োজন করে ব্রেসলেটটি আবার পরিয়ে দেওয়া হবে মাশরাফির হাতে। (বিডিনিউজটুয়েন্টিফোর.কম, ১৮ মে-২০২০)।
এই যে এতোক্ষণ যে গল্প বলেছি সেটা অবিশ্বাস্য এ কারণেই বললাম যে, কেউ কারো জিনিস নিলামে কিনে নিজের ঘরে নিয়ে রাখে স্মৃতি হিসেবে। অথচ মমিন ইউ ইসলাম করলেন তার উল্টো। তিনি সম্মান দেখালেন ‘দেশপ্রেমিক’ মাশরাফিকে। উদারতা দেখালেন এই বীরকে। যিনি দেশের জন্য লড়ে এসেছেন এবং এখনও লড়ছেন। আর তাইতো বলেছেন, নিলাম থেকে পাওয়া অর্থে ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে নড়াইলে এবং এর বাইরেও। এই একটি ব্রেসলেটের মাধ্যমে পাওয়া অর্থ কাজে লাগবে দরিদ্র অসহায়দের জীবনে। তিনি তার ব্রেসলেটের মূল্যও পেয়েছেন, সেই সাথে ফিরে পাচ্ছেন তার ‘১৮ বছরের সুখ-দুঃখের সাথী’ প্রিয় ব্রেসলেটটিও। আর এর পেছনের ‘নায়ক’ মমিন ইউ ইসলামও ইতিহাসের পাতায় থাকলেন স্মরণীয় হয়ে।
লেখক: আকাশ চৌধুরী
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।