বিশেষ প্রতিবেদন: বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে মো. সাহাবুদ্দিন চুপ্পুকে বেছে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আপসহীন, বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক ক্যারিয়ার এবং অতীত কর্মজীবনে নিষ্ঠা-সততা-দক্ষতার কারণে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সম্মুখ সারির এই যোদ্ধাকে বেছে নেওয়া হয়েছে বলে দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে। আইন বিষয়ে দক্ষ চুপ্পু দেশের নতুন রাষ্ট্রপতি হিসেবে সুন্দরভাবে দায়িত্ব পালনে সক্ষম হবেন বলেও প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন দলটির নেতারা। তারা মনে করেন, আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের দেওয়া সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের আলোকে দলীয় সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেরা ব্যক্তিকেই বেছে নিয়েছেন।
১৯৬৬ সালে তিনি জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। জেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন। অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের আগেই তিনি দেশের স্বাধীনতার পক্ষে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের পরেও তিনি লেখাপড়ার পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। যার কারণে পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর তাকে তিন বছর কারাবরণ করতে হয়। অনেক অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হন তিনি।
সাহাবুদ্দিন চুপ্পু খুবই মেধাবী উল্লেখ করে ফারুক খান বলেন, জেল থেকে বের করে তিনি লেখাপড়া শেষ করে যোগ্যতার স্বাক্ষর থেকে বিসিএস জুডিসিয়াল সার্ভিসে যুক্ত হন। কর্মজীবনে তিনি সততা, দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবেও দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন নিষ্ঠা ও সম্মান নিয়ে। পরবর্তীতে তাকে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদেরও সদস্য করা হয়েছে।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে মুহম্মদ ফারুক খান বলেন, ১৯৯৮ সালে আমার নেতৃত্বে একটি টিম কয়েকটি দেশের সংসদের কার্যক্রম পরিদর্শনের জন্য পাঠানো হয়। ওই টিমে তিনিও (চুপ্পু) সদস্য ছিলেন। আমরা ব্রিটেন, সুইজারল্যান্ড ও যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্ট পরিদর্শন করি। তখন থেকে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। ওই সফরে আমি তার দক্ষতার প্রমাণ পেয়েছি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে একজন অমায়িক, ভদ্র ও মার্জিত মানুষ। ব্যক্তিগতভাবে মনে করি রাষ্ট্রপতি হিসেবে তিনি বেস্ট চয়েজ। তিনি একজন ভালো রাষ্ট্রপতি হবেন। ব্যক্তিগতভাবে আইনজীবী ও সাবেক জজ হওয়ায় আইনগত বিষয়ে তিনি দক্ষতার স্বাক্ষর রাখবেন। দেশের নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশের প্রতি অনুগত্য, দেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস এবং ব্যক্তিগত দক্ষতা ও অতীতের কর্মময় জীবনের কারণেই তাকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আমি মনে করি এটা বেস্ট চয়েজ।
তিনি বলেন, পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্রনেতা থেকে শুরু করে জেলা ছাত্রনেতা। জেলা যুবলীগের সভাপতি ছিলেন সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। ৭৫ পরবর্তী সময়ে তিনি তিন বছর কারাভোগ করেছেন। কর্মজীবনে বিভিন্ন সময়ে যেসব দায়িত্ব তিনি পালন করেছেন তা তিনি সততা, নিষ্ঠা ও যোগ্যতার সঙ্গে পালন করেছেন। তিনি একজন সজ্জন। সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে আমাদের দলীয় সভাপতি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা সবার মতামত নিয়ে তাকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছেন।
নির্বাচনের তফসিল অনুযায়ী, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র জমার সময় ছিল ১২ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। তবে এদিন আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনও দল বা ব্যক্তি মনোনয়নপত্র জমা দেননি। ১৯৪৯ সালের ১০ ডিসেম্বর পাবনার জন্ম সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর। রাষ্ট্রপতি পদে জমা দেওয়া মনোনয়নপত্রের তথ্য অনুযায়ী, তার বাড়ি পাবনা সদর থানার শিবরামপুরে। ঢাকায় তিনি থাকেন গুলশানে।
সাহাবুদ্দিন চুপ্পুর বাবা শরফুদ্দিন আনছারী ও মা খায়রুন্নেসা। তিনি পাবনা শহরের পূর্বতন গান্ধী বালিকা বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর রাধানগর মজুমদার অ্যাকাডেমিতে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হন।
১৯৬৬ সালে এসএসসি পাস করার পর পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ থেকে ১৯৬৮ সালে এইচএসসি ও ১৯৭১ সালে (অনুষ্ঠিত ১৯৭২ সালে) বিএসসি পাস করেন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে মনোবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর এবং পাবনা শহীদ অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন আইন কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে এলএলবি ডিগ্রি অর্জন করেন।
ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে তার পথচলা। দীর্ঘদিন পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ছাত্রলীগ নেতা হিসেবেই তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তিনি পাবনা জেলা স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন। ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে তিনি পাবনা অঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। তিনি পরে যুবলীগের রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হন। ১৯৭৪ সালে জেলা যুবলীগের সভাপতি হন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হলে তার প্রতিবাদ জানান তিনি। তখন গ্রেফতার হয়ে বেশ কয়েক বছর জেল খাটেন সাহাবুদ্দিন। এ সময় তিনি নির্যাতনেরও শিকার হন।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা, হত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের ঘটনা তদন্তে পরবর্তী সময়ে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশনের চেয়ারম্যান (সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির পদমর্যাদায়) হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন চুপ্পু। ২০০১ সালের সংসদ নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার কারণ ও সুপারিশ প্রণয়নের জন্য গঠিত কমিশনের দাখিলকৃত প্রতিবেদন সরকার গেজেট আকারে প্রকাশ করে।
আওয়ামী লীগ সভাপতি তার গঠনতান্ত্রিক ক্ষমতাবলে ২০২০ সালের ৭ জানুয়ারি দলের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য হিসেবে চুপ্পুকে মনোনয়ন দেন। দলের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এইচটি ইমামের মৃত্যুতে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত শূন্য থাকা পদটিতে গত বছর (২০২২) ১৪ জানুয়ারি তাকে চেয়ারম্যান করা হয়। আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটিরও উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য হন চুপ্পু।
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মালিকানায় ব্যাপক পরিবর্তন এলে জেডএমসি বিল্ডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি হিসেবে ২০১৭ সালের জুন মাসে ব্যাংকটির পরিচালক হন চুপ্পু। পরে তিনি ব্যাংকটির ভাইস প্রেসিডেন্টেরও দায়িত্ব পালন করেন।
সাহাবুদ্দিন চুপ্পু ১৯৯৫ সালে পর পর দুইবার বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব নির্বাচিত হন। পেশাগত জীবনে প্রথম দিকে সাংবাদিকতাও করেছেন। তিনি পাবনা প্রেসক্লাব ও অন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরির জীবন-সদস্য।
১৯৭২ সালের ১৬ নভেম্বর পাবনা শহরের দিলালপুর নিবাসী আলী আকতারের জ্যেষ্ঠ কন্যা ড. রেবেকা সুলতানার সঙ্গে সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। রেবেকা সুলতানা বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দিয়ে যুগ্ম-সচিব হিসেবে ২০০৯ সালে অবসরে যান।
ড. রেবেকা বর্তমানে প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যান রিসোর্চ প্রোগ্রাম বিভাগের অধ্যাপক এবং ফ্রেন্ডস ফর চিলড্রেন অর্গানাইজেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান। চুপ্পু-রেবেকা দম্পতির একমাত্র সন্তান মো. আরশাদ আদনান রনি দেশে ও বিদেশে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে বর্তমানে বেসরকারি প্রাইম ব্যাংকের উচ্চপদে কর্মরত।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।