ডেস্ক রিপোর্ট : নিউইয়র্ক সিটির আসন্ন সিটি কাউন্সিল নির্বাচনে শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কিছু কাউন্সিল সদস্য যখন নতুন আইন প্রণয়নের চেষ্টা করছেন, তখন প্রযুক্তি জায়ান্ট উবার এবং ডোরড্যাশ মিলিয়ন ডলারের রাজনৈতিক ব্যয় শুরু করেছে। এই ব্যয়ের লক্ষ্য একদিকে কিছু প্রগতিশীল কাউন্সিল সদস্যকে পুনঃনির্বাচনে সাহায্য করা, আবার অন্যদিকে কয়েকজন বিদায়ী বা তাদের বিরোধীদের সমর্থন করা। মূল লক্ষ্য হচ্ছে, নিজেদের স্বার্থে উপযুক্ত প্রার্থীদের জিতিয়ে আনা। সাম্প্রতিক সময়ে সিটি কাউন্সিল ফুড ডেলিভারি কর্মীদের জন্য একটি ন্যূনতম মজুরির হার নির্ধারণ করে। এটি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রথম এমন আইন। একই ধরনের নীতি এর আগে রাইড-হেইল (যেমন উবার) চালকদের জন্যও গ্রহণ করা হয়েছিল। উবার ও ডোরড্যাশ এসব আইনকে আইনি চ্যালেঞ্জ করলেও শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর থাকে। এতে কাউন্সিল সদস্যরা আরও বেশি সুরক্ষামূলক আইন প্রস্তাব করতে উৎসাহিত হন।
তবে এর বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে উবার ও ডোরড্যাশ এখন প্রার্থীদের পেছনে অর্থ ঢালছে। উবারের নিউইয়র্ক পলিটিক্যাল অ্যাকশন কমিটি (পিএসি) ইতোমধ্যে ১১টি সিটি কাউন্সিল ডিস্ট্রিক্টে বিভিন্ন প্রার্থীর পক্ষে ১৩ লাখ ডলার ব্যয় করেছে। এর মধ্যে শুধু ব্রুকলিনের ৩৯তম ডিস্ট্রিক্টে শাহানা হানিফের বিরুদ্ধে মায়া কর্নবার্গের প্রচারে ডিজিটাল বিজ্ঞাপন ও মেইলারের পেছনে ব্যয় হয়েছে এক লাখ ডলারের বেশি। শাহানা হানিফ, যিনি ব্রুকলিন থেকে প্রথম মুসলিম কাউন্সিল সদস্য এবং একজন প্রগতিশীল ডেমোক্র্যাটিক সোশালিস্ট, তিনি এমন একটি বিলের প্রধান স্পন্সর যা গিগ কর্মীদেরও পেইড সিক লিভের আওতায় আনবে। তিনি আরেকটি বিলের সহ-স্পন্সর, যা কোনো কারণ ছাড়া ডেলিভারি কর্মীদের অ্যাকাউন্ট বন্ধ করা ঠেকাতে চায়। এই অবস্থান উবারের অনিষ্ট স্বার্থে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে হানিফ জানান। তিনি বলেন, আমার নির্বাচনে উবারের হস্তক্ষেপ কেবলমাত্র তাদের কর্পোরেট লোভের বহিঃপ্রকাশ। আমি শ্রমিকদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছি, এজন্য তারা আমাকে অপসারণ করতে চায়।
উবারের সিনিয়র পাবলিক পলিসি পরিচালক জশ গোল্ড এক বিবৃতিতে বলেন, নগর রাজনীতিকরা এমন নীতিমালা গ্রহণ করেছেন, যা চালকদের জন্য ব্যয়বহুল এবং আয় করা কঠিন করে তুলেছে। আমরা এমন প্রার্থীদের সমর্থন করছি, যারা পরিবহন ব্যবস্থাকে আরও সাশ্রয়ী ও কার্যকর রাখতে চান। উবার যেসব প্রার্থীদের সমর্থন করছে তাদের মধ্যে রয়েছেনঃ মায়া কর্নবার্গ (শাহানা হানিফের প্রতিদ্বন্দ্বী), মার্সেডেস নারসিস ও ডারলিন মিলি (ব্রুকলিন), কারমেন দে লা রোজা ও জুলি মেনিন (ম্যানহাটন), এরিক দিনোউইটজ (ব্রঙ্কস), এবং ক্রিস্টাল হাডসন (ব্রুকলিন), যিনি শ্রমিকদের জন্য ‘অ্যাকাউন্ট লকআউট’ বিলের সহ-স্পন্সর।
বিশেষ করে, জুলি মেনিন এবং এরিক দিনোউইটজ – যাদের উবার স্পিকার পদে সম্ভাব্য সমর্থনদাতা হিসেবেও বিবেচনা করছে – তাদের জন্য যথাক্রমে ৪৫,৫৬১ ও ৩৭,২২০ ডলার ব্যয় করা হয়েছে। ডোরড্যাশও বসে নেই। তারা ‘লোকাল ইকোনমিজ ফরোয়ার্ড এনওয়াই’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক একশন কমিটি গঠন করেছে এবং ক্রেইনসকে জানিয়েছে, তারা জুন ২৪-এর নির্বাচনে দুই মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত ব্যয় করবে। তারা জুলি মেনিন, কেভিন রাইলি (স্পিকার পদে সম্ভাব্য প্রার্থী), এবং কয়েকজন নতুন প্রার্থীর পক্ষে ব্যয় করছে, যারা টার্ম-লিমিটেড কাউন্সিল সদস্যদের জায়গায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। শ্রমিকদের অধিকার রক্ষাকারী সংগঠনগুলো উবার ও ডোরড্যাশের এহেন রাজনৈতিক ব্যয়ের কঠোর সমালোচনা করেছে। লস ডেলিভেরিস্টাস ইউনিডোসের প্রতিষ্ঠাতা ও ডেলিভারি কর্মী সার্জিও আচে বলেন, “এই কোম্পানিগুলো সবসময় তাদের স্বার্থে নীতিমালা পরিবর্তন করতে চায়, অথচ শ্রমিকদের নিরাপত্তা বা ভালো কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করতে চায় না।”
ওয়ার্কার্স জাস্টিস প্রজেক্টের নির্বাহী পরিচালক লিজিয়া গুয়ালপা বলেন, “বিলিয়ন ডলারের কোম্পানিগুলো নির্বাচনে মিলিয়ন ডলার ঢালছে, অথচ সেই অর্থ দিয়ে যদি শ্রমিকদের নিরাপত্তা, মজুরি বা ওয়ার্কার্স কম্পেনসেশনে বিনিয়োগ করত, তাহলে বাস্তব পরিবর্তন হতো।” নিউইয়র্ক ট্যাক্সি ওয়ার্কার্স অ্যালায়েন্স-এর নির্বাহী পরিচালক ভৈরবী দেসাই বলেন, “উবার আমেরিকার কর্পোরেট রাজনীতির সর্বনিম্ন পর্যায়ের প্রতীক। তারা ন্যূনতম মজুরির বিরুদ্ধে লড়াই করে, আবার চালকদের অন্যায়ভাবে ছাঁটাই করতেও দ্বিধা করে না।”২০১০ সালের ‘সিটিজেনস ইউনাইটেড’ মামলার রায়ে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট নির্ধারণ করে যে, রাজনৈতিক কর্মসূচির জন্য রাজনৈতিক একশন কমিটিগুলো সীমাহীন অর্থ ব্যয় করতে পারে, যতক্ষণ না তারা সরাসরি প্রার্থীদের প্রচারে অংশ নিচ্ছে না। নিউইয়র্ক সিটি যদিও ডোনারদের পরিচয় প্রকাশের নিয়ম করেছে, তবুও এই অর্থনীতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব প্রশ্ন তুলছে নগরের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
শাহানা হানিফ বলেন, “ডিস্ট্রিক্ট ৩৯ বিক্রি হওয়ার জায়গা নয়। আমরা রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং প্রগতিশীল জনগণের এলাকা। আমরা উবারের নির্বাচনী খেলা চিনে ফেলেছি।” তিনি উল্লেখ করেন যে তার নির্বাচনী প্রচারে প্রগতিশীল রাজনীতিবিদ ও শ্রমিক সংগঠনগুলোর সমর্থন রয়েছে। কংগ্রেসওম্যান আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কার্টেজ , কম্পট্রোলার ব্র্যাড ল্যান্ডার ও স্টেট অ্যাসেম্বলিমেম্বার জোহরান মামদানি ইতোমধ্যে শাহানা হানিফকে সমর্থন দিয়েছেন। নিউইয়র্ক সিটির আসন্ন কাউন্সিল নির্বাচন একটি বড় পরীক্ষা হয়ে উঠছে—শ্রমিকদের অধিকার সংরক্ষণ নাকি কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষা, কোনটি নগরবাসী বেছে নেবে? উবার ও ডোরড্যাশের রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ প্রমাণ করে, প্রযুক্তিভিত্তিক গিগ-ইকোনমি কোম্পানিগুলোর প্রভাব স্থানীয় রাজনীতিতেও গভীরভাবে প্রবেশ করেছে। তবে এই মুহূর্তে প্রশ্ন একটাই—এখনো কি এই শহর শ্রমিকবান্ধব নীতির পক্ষেই রায় দেবে?
Desk: K
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।