ইমরানের সাজা: পাল্টে যেতে পারে পাকিস্তানের রাজনীতি
০১ ফেব্রু ২০২৪, ০৩:২৯ অপরাহ্ণ

সম্পাদকীয়: পাকিস্তানের বিশেষ আদালত মঙ্গলবার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান
এবং তাঁর সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ‘অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট’ লঙ্ঘনের দায়ে ১০
বছরের কারাদণ্ড দেয়। পরদিন বুধবার তোশাখানা দুর্নীতি মামলায় ইমরান-বুশরা
দম্পতিকে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচনের এক
সপ্তাহ আগে আদালতের এই রায়কে অনেকেই ‘পূর্বনির্ধারিত’ আখ্যা দিচ্ছেন। ইমরান
খানের বেশ কয়েকজন পূর্বসূরির ভাগ্যেও এমনটি হয়েছে, যেখানে বিতর্কিত রায় দিয়ে
রাজনৈতিক নেতাদের দৃশ্যপটের বাইরে রাখা হয়েছে। বস্তুত এর মাধ্যমে মানুষের কাছে
বিশেষ বার্তা দেওয়া হয়েছে।
মজার ব্যাপার, এই প্রথম পাকিস্তানের কোনো রাজনৈতিক নেতা অফিসিয়াল সিক্রেট
তথা দাপ্তরিক গোপনীয়তা প্রকাশের দায়ে দণ্ডিত হলেন। ইমরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ
আনা হয়েছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলে কূটনৈতিক নথি ব্যবহার এবং গোপন
যোগাযোগ করেছেন তিনি। ইমরান অবশ্য দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিলেন, নথিতে মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের তরফে হুমকি ছিল এবং এটি প্রমাণ করে যে ওয়াশিংটন এবং তৎকালীন
সেনা নেতৃত্বের যোগসাজশে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে তাঁর সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়।
কোনো সন্দেহ নেই যে ইমরান খান ওয়াশিংটন থেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের পাঠানো
তাঁর সরকারকে উৎখাতের সাইফার বার্তাটি ভুলভাবে ব্যবহার করেছিলেন। অনাস্থা
ভোটের মাধ্যমে তাঁর সরকারকে অপসারণের কয়েক সপ্তাহ আগে তিনি এক রাজনৈতিক
সমাবেশে তথাকথিত নথির কথা বলে জনসাধারণকে উত্তেজিত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর
সে বয়ান কাজ করে এবং সেটি তাঁর সমর্থকদের উত্তেজিত করে তোলে।
ইমরান খানের এই দণ্ডাদেশের ফলে পাকিস্তানে রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং
অস্থিতিশীলতা আরও বাড়বে। এটি স্পষ্ট, তিনি যে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেছিলেন,
তা তাঁকে সামরিক নেতৃত্বেরও মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়। অথচ সেনাবাহিনী এক সময়
তাঁর সরকারকে সমর্থন দিয়েছিল। বস্তুত, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর এমন
দায়িত্বজ্ঞানহীন পদক্ষেপ ন্যায্য হতে পারে না। কিন্তু দৃশ্যত এটিও স্পষ্ট, আইনের
যে ধারায় তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, তাতে প্রতিশোধের ইচ্ছাই প্রতিভাত হয়ে ওঠে।
কারাগারের অভ্যন্তরে আদালতের কার্যক্রম পরিচালনার প্রক্রিয়া সন্দেহের
অভিযোগকে আরও শক্তিশালী করছে। তা ছাড়া নির্বাচনের মাত্র কয়েক দিন আগে
ঘোষিত এমন রায় পরিস্থিতি ঘোলাটে করারই ইঙ্গিতবাহী।
মঙ্গলবারের ঘটনাটি ছিল পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দোষী
সাব্যস্ত হওয়ার দ্বিতীয় ঘটনা। এর আগে গত আগস্টে তোশাখানা মামলায় তাঁকে শাস্তি
দেওয়া হয়। তখন তিন বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়ে তিনি নির্বাচনের জন্য অযোগ্য
হন। একই সঙ্গে তাঁর গড়া পিটিআইর ওপর নজিরবিহীন দমনপীড়ন চালিয়ে দলটির
মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া হয়। দেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে
প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে রাখার জন্যই এসব করা হয়। পাকিস্তানের নির্বাচন
কমিশনের সিদ্ধান্ত সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক বহাল রাখা এবং দলটিকে তার নির্বাচনী
প্রতীক হিসেবে ক্রিকেট ব্যাট না দেওয়ার সিদ্ধান্তও দলটির নির্বাচনে
প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে বড় ধাক্কা।
এসব রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন সত্ত্বেও পিটিআই নির্বাচনে এক গুরুত্বপূর্ণ শক্তি। যে
কারণে নির্বাচনের ঠিক আগে এর দুই প্রধান নেতার রায় ঘোষণা করা হয়েছে, যাতে
দলটির সমর্থকদের মধ্যে হতাশা কাজ করে। অথচ এ ঘটনা সমর্থকদের দলটির পক্ষে
বেশি করে ভোট দিতে অনুপ্রাণিত করতে পারে, শেষ পর্যন্ত যার বিপরীত ফলও দেখা
যেতে পারে।
এমন পরিস্থিতিতে পিটিআইর পক্ষের জোয়ার থামানো সামরিক বাহিনীর জন্য কঠিন
হতে পারে। বিতর্ক থাকলেও বলা যায়, এখন পাকিস্তানের সবচেয়ে জনপ্রিয় রাজনৈতিক
নেতা ইমরান খান। এ সময়ে তাঁর দণ্ডাদেশ পাকিস্তানের পুরো রাজনৈতিক পরিবেশ বদলে
দিতে পারে। অতীতের ঘটনাপ্রবাহের শিক্ষা হলো, জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতাদের
বিরুদ্ধে এমন পদক্ষেপ কখনোই সফল হয়নি। বস্তুত, এ সময়ের এমন রায় সাবেক
প্রধানমন্ত্রীর সমর্থন আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। বলা বাহুল্য, তাঁর সমর্থকরা
প্রধানত তরুণ এবং তারাই ভোটারের দিক থেকে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
সেনাবাহিনী সেখানে অন্যান্য মূলধারার রাজনৈতিক দল নিয়ে যে খেলা খেলছে, ক্ষমতার
সে খেলাও নষ্ট করতে পারে ইমরান খানের দণ্ডাদেশ। পাকিস্তানের এবারের নির্বাচনে
রাজনৈতিক দলগুলোর যে নিষ্প্রভ প্রচারণা দেখা যাচ্ছে, তাতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার
প্রতি মানুষের হতাশা আরও বাড়ছে। পিটিআইসহ ভিন্ন মতাবলম্বীদের নিশানা করে
চলমান দমনপীড়ন এরই মধ্যে অত্যন্ত সংকটপূর্ণ পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে।
এর মধ্য সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, ইমরান খানের সাজার ফলে যে রাজনৈতিক
মেরুকরণ ও অস্থিতিশীলতার জন্ম হবে, তা সামগ্রিক গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে
হুমকির মুখে ফেলতে পারে। নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা এরই মধ্যে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
ফলে পাকিস্তানে স্থিতিশীলতা বিরাজ করবে– এমন সম্ভাবনা ক্ষীণ।
কারণ, সংশয়পূর্ণ এমন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসবে দুর্বল এক বেসামরিক
সরকার। যার পক্ষে অর্থনৈতিক ও জাতীয় নিরাপত্তা সংকট সুষ্ঠুভাবে সামাল দেওয়ার
সম্ভাবনা কম। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া দুর্বল হওয়ার ফলে এরই মধ্যে
সামরিক বাহিনীর ছায়া ক্ষমতা কাঠামোর ওপর দেখা যাচ্ছে। যার প্রমাণ জনপরিসরের
এক সমাবেশে সেনাপ্রধানের সাম্প্রতিক মন্তব্য, যেখানে তিনি বিদ্যমান রাজনৈতিক
ব্যবস্থা সম্পর্কে সমালোচনা করেছেন। তাঁর বক্তব্য সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনেও
এসেছে।
পাকিস্তানে সেনাপ্রধানদের নিজস্ব বলয়ের বাইরের বিষয়ে কথা বলা অস্বাভাবিক নয়।
সে জন্যই সেনাপ্রধান যখন দায়িত্বশীল শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে
রাজনীতি, অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি এবং ধর্মের মতো বিষয়ে কথা বলেছিলেন, তাতে
অবাক হওয়ার সুযোগ সামান্যই। তাঁর সে বক্তব্য নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিও প্রতিভাত
হয়েছিল, যেখানে তিনি বলেছিলেন– কীভাবে পাকিস্তান প্রতিশ্রুত লক্ষ্য অর্জন করতে
পারে। ফলে কেউ কেউ একে ‘জেনারেল অসিম মুনির মতবাদ’ হিসেবে চিত্রিত করেছেন।
এটিই প্রথম নয়; একই ধরনের মন্তব্য অন্যান্য সেনাপ্রধানও করেছিলেন। সাবেক
সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়াও দেশকে সঠিক পথে পরিচালিত করার
জন্য নিজের ‘মতবাদ’-এর কথা বলেছিলেন।
এটি এ কারণেই কৌতূহলোদ্দীপক যে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সেনাপ্রধানের মতবিনিময়
এমন সময়ে ঘটেছে, যখন নির্বাচনটি আসন্ন। এমনটি কাকতালীয় হতে পারে না যে
ইমরান খানের এমন সাজা ঘোষণার কয়েক দিন আগে তিনি জনপরিসরের আয়োজনে
উপস্থিত হয়েছিলেন। কারণ, সেটি অরাজনৈতিক আলোচনা ছিল না এবং দেশের
ভবিষ্যতের সঙ্গে এর সম্পর্ক রয়েছে। অবশ্য রাজনীতি সম্পর্কে সেনাপ্রধানের
আলোচনার বেশির ভাগেই বেসামরিক রাজনৈতিক নেতাদের বিষয় এসেছে; যেখানে
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিষয়ে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আরও ভালোভাবে সামনে এসেছে।
পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের ইঙ্গিত না থাকলেও এটি স্পষ্ট– তারা
বেসামরিক নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে দিতে চাইছে না। রাজনীতিবিদদের
মধ্যে অবিশ্বাস স্পষ্ট। যদিও নির্বাচন হবে তাতে সন্দেহ নেই। তবে ইমরান খানের
সাজা ঘোষিত হওয়ার পর রাজনৈতিক দৃশ্যপট কেমন হয়, সেটিই এখন দেখার বিষয়।