সালভাদর দালি: গোঁফ দিয়ে যায় চেনা - BANGLANEWSUS.COM
  • নিউইয়র্ক, রাত ৮:৫২, ৮ই অক্টোবর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ


 

সালভাদর দালি: গোঁফ দিয়ে যায় চেনা

newsup
প্রকাশিত মে ১১, ২০২৪
সালভাদর দালি: গোঁফ দিয়ে যায় চেনা

নিউজ ডেস্ক: পাগল আর আপনার মধ্যে পার্থক্য কী—এই প্রশ্ন যদি করা হয়, তবে এককথায় কী বলবেন? ভাবনায় ফেললাম?

খুব সহজ উত্তর দিয়েছিলেন সালভাদর দালি, যিনি তাঁর চিত্রকলার জন্য যত খ্যাতিমান, ততটাই পরিচিত তাঁর আইকনিক গোঁফের জন্য। বিখ্যাত এই স্প্যানিশ শিল্পী নিউইয়র্কে এক আলোচনায় বলেছিলেন, ‘আমার এবং একজন পাগলের মধ্যে একমাত্র পার্থক্য হলো, আমি পাগল নই।’

‘পাগল’ বিষয়ের অবতারণা হয়েছিল সম্ভবত দালির ‘উদ্ভট’ শিল্পকর্ম, সাজসজ্জা ও জীবনযাপনের কারণে। আজ এই মহান শিল্পীর ১২০তম জন্মদিন।

সালভাদর দালির পুরো নামটি বেশ লম্বা—সালভাদর ডোমিঙ্গো ফেলিপে জ্যাকিন্টো ডালি ডোমেনেচ। ১৯০৪ সালের ১১ মে তাঁর জন্ম স্পেনের কাতালোনিয়ার ফরাসি সীমান্তের কাছে ফিগারেস শহরে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে। তাঁর বাবা সালভাদর লুকা রাফায়েল অ্যানিসেতো ডালি কুসি ছিলেন আইনজীবী। মা ফেলিপা ডোমেনেচ ফেরেস। তিনি শৈশব থেকেই দালিকে তাঁর শৈল্পিক প্রতিভা বিকাশে উৎসাহিত করেছিলেন।

জীবনের শুরুতেই দুটি মৃত্যুর প্রচণ্ড আঘাত সহ্য করতে হয়েছিল দালিকে। সারা জীবন তিনি এই বেদনা বয়ে বেড়িয়েছেন। তাঁর চিত্রকলা ও রচনায় এটি নানাভাবে প্রভাব রেখেছে। দালির তিন বছরের বড় ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে শৈশবেই, আর মা মারা গিয়েছিলেন তাঁর ১৬ বছর বয়সে। মায়ের মৃত্যুর পর দালির খালাকে বিয়ে করেছিলেন তাঁর বাবা। তাঁর প্রতিও দালির অগাধ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল। তবে বাবার সঙ্গে দালির সম্পর্কের অবনতি হয়েছিল এলেনা ইভানোভনা দিয়াকোনোভার সঙ্গে দালির সম্পর্ক ও বিয়ের কারণে। এলেনা ‘গালা’ নামেই পরিচিত ছিলেন। বয়সে তিনি দালির চেয়ে প্রায় ১০ বছরের বড় এবং প্রথমে তাঁর বিয়ে হয়েছিল কবি পল এলুয়ার্ডের সঙ্গে। দালির সঙ্গে গালার দেখা হয়েছিল ১৯২৯ সালে। ১৯৩৪ সালে তাঁরা বিয়ে করেন। দালির সঙ্গেই তিনি পুরো জীবন কাটিয়েছেন। দালির বাবা এই বিয়ে মেনে নেননি।

সালভাদর দালির প্রাতিষ্ঠানিক শিল্পশিক্ষা শুরু হয়েছিল মাদ্রিদের সান ফার্নান্দো ইনস্টিটিউটে। এই ইনস্টিটিউটে তাঁর প্রবেশ করেছিলেন ১৯২২ সালে। চিত্রকলা ও ভাস্কর্যে অধ্যয়ন করেছেন। মাদ্রিদে থাকার সময়েই বিখ্যাত কবি ফেডরিকো গার্সিয়া লোরকা ও চলচ্চিত্র নির্মাতা লুইস বুনুয়েলের সঙ্গে তাঁর গভীর সখ্য হয়। প্রথম দিকে দালি ইমপ্রেশনিমজ ও রেনেসাঁ যুগের শিল্পধারায় প্রভাবিত ছিলেন। দালির শিল্পকর্মের প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল ১৯২৫ সালে, বার্সেলোনায়।

দালি ফ্রান্সে পাড়ি জমান ১৯২৬ সালে। সেখানে স্বদেশি চিত্রকলার আরেক দিক্‌পাল পাবলো পিকাসোর সঙ্গে পরিচয় হয়। প্যারিসে দালির সঙ্গে সমসাময়িক কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। প্রাথমিকভাবে তিনি কিউবিজমের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। পরে পরাবাস্তববাদী শিল্পীদের দলে যোগ দেন। প্যারিসে তাঁর চিত্রকর্মের প্রথম প্রদর্শনী হয় ১৯২৬ সালে। এই প্রদর্শনীর মধ্য দিয়েই তিনি শিল্প-সমালোচকেদের নজর কাড়েন। এরপর ধীরে ধীরে চূড়ান্ত পরিণতি ও খ্যাতির দিয়ে এগিয়ে যান।

১৯৩৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দালির প্রথম চিত্রকর্ম প্রদর্শনী হয়। প্রথমবারেই যাকে বলে ‘কেল্লা ফতে’। বিপুল প্রচার পেয়েছিলেন তিনি। পরে যুক্তরাষ্ট্রে তিনি দীর্ঘ সময় বসবাস করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম প্রদর্শনীর সময় মিউজিয়াম অব মডার্ন আর্টে পরাবাস্তব চিত্রকলা নিয়ে বক্তব্য দেন তিনি। সেখানেই পাগল আর তাঁর পার্থক্য নিয়ে ওই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা ও স্পেনে শুধুই দালির শিল্পকর্ম নিয়ে দুটি জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

সালভাদর দালি ছিলেন বিপুল বহুমুখী প্রতিভাবান শিল্পী। চিত্রকলা ছাড়াও ভাস্কর্য, গ্রাফিক ডিজাইন করেছেন। তিনি জীবনী, উপন্যাস, প্রবন্ধ, শিল্প-সমালোচনা, অপেরা, চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য রচনা করেছেন। ফ্যাশন ফটোগ্রাফি, চলচ্চিত্র নির্মাণে যুক্ত হয়েছেন। তাঁর জীবনী গ্রন্থ ‘দ্য সিক্রেট লাইফ অব সালভাদর দালি’। একমাত্র উপন্যাস ‘হিডেন ফেসেস’।

‘দ্য পারসিসটেন্স অব মোমোরি’ নামের চিত্রকর্মটি দালি এঁকেছিলেন ১৯৩১ সালে। সমালোচকেরা একমত যে, এটিই তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ। গাছের ডাল থেকে ঝুলছে একটি ঘড়ি। যেমন করে লোকে তারে কাপড় শুকাতে দেয়, অনেকটা তেমন। পাশে আরও কয়েকটি ঘড়ি পড়ে আছে। একটি ঘড়ির মধ্যে কতগুলো কালো পিঁপড়া সময় খেয়ে ফেলছে। আরেকটি ঘড়ির ভেতরে বসেছে মাছি। একটুকরা পনিরের গলতে থাকার এক দৃশ্যে থেকে দালি এই ছবির প্রেরণা পেয়েছিলেন। এই চিত্রকর্মকে পরাবাস্তব চিত্রকলার সার্থক একটি উপস্থাপনা বলে সমালোচকেরা মেনেছেন। নানাভাবে নানাজনে এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এটি ছাড়া ‘দ্য ফার্স্ট ডেজ অব স্প্রিং’,‘দ্য লুগুব্রিয়াস গেম’, ‘দ্য গ্রেট মাসটারবেটর’, ‘টুনা ফিশিং’—দালির বিখ্যাত কাজগুলো মধ্যে অন্যতম। দালির সর্বশেষ শিল্পকর্ম ‘দ্য সোয়ালোস টেইল’ দর্শকদের সামনে প্রদর্শন করা হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। দালির শিল্পকলা মার্কিন পপ আর্টের ধারার উন্মেষ ঘটিয়েছিল বলে শিল্প-সমালোচকেরা মনে করেন। পরে এই ধারার বিখ্যাত শিল্পীদের ওপর দালির কাজের প্রভাব পড়েছিল। সমালোচকেরা তাঁর কাজকে ‘উদ্ভট’, আলাদা, বিভ্রম সৃষ্টিকারী—এভাবেই উল্লেখ করেছেন। তাঁর চিত্রকর্ম দেখার অভিজ্ঞতা একেবারেই আলাদা।

চিত্রকলা ছাড়াও দালি তাঁর বন্ধু লুইস বুনুয়েলের সঙ্গে ১৯২৯ সালে এন আন্দালুসিয়ান ডগ নামে ১৬ মিনিটের একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। পরাবাস্তববাদী চলচ্চিত্র আন্দোলনের সূচনার ছবিটি এখনো চলচ্চিত্র বোদ্ধা ও অনুরাগীদের প্রিয় হয়ে আছে। এ ছাড়া তিনি আরেক বিখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা আলফ্রেড হিচককের ‘স্পেলবাউন্ড’ চলচ্চিত্রেও গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ করেছেন।

দালির শিল্পকলায় বারবার মনোজগতের অবচেতন অবস্থা, স্বপ্ন, যৌনতা, ব্যক্তিগত সম্পর্কের স্মৃতি, বিজ্ঞান এমনকি ধর্মের বিষয়ও নানা প্রভাব ফেলেছে। তাঁর চিত্রকর্মে প্রাণী ও খাদ্যদ্রব্য বিশেষ প্রতীক হিসেবে ঘুরেফিরে এসেছে। দর্শকেরা তাঁর চিত্রকর্মে প্রাণীর মধ্যে গন্ডার, গাধা, পিঁপড়া, শামুক; খাবারের মধ্যে পাউরুটি, পনির, মটরশুঁটি, চিংড়ি প্রায়ই দেখে থাকবেন।

এবার আসা যাক দালির বিখ্যাত গোঁফটি নিয়ে। দালি যেমন তাঁর ছবির জন্য বিখ্যাত, তেমনি তাঁর গোঁফজোড়ার জন্যও যথেষ্ট খ্যাতিমান। সেই যেমন সুকুমার রায় বলেছিলেন, ‘গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা’… সালভাদর দালিকে চেনা যায় তাঁর মোম দিয়ে পাকানো বল্লমের ফলার মতো তীক্ষ্ণ গোঁফজোড়া দিয়ে। দালি এই গোঁফ রাখতে শুরু করেছিলেন গত শতাব্দীর বিশের দশকের দিকে। পরে এই গোঁফজোড়া তাঁর বিখ্যাত আইকনে পরিণত হয়েছিল।

সালভাদর দালি একসময় স্পেনের স্বৈরশাসক জেনারেল ফ্রাঙ্কোকে সমর্থন করায় তাঁকে পরাবাস্তববাদী শিল্পীদের সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালে প্রায় আট বছর যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করেন দালি দম্পতি। পরে তাঁরা ১৯৪৮ সালে স্বদেশে ফেরেন। আমৃত্যু সেখানেই থেকেছেন।

দালির স্ত্রী গালা ৮৭ বছর বয়সে ১৯৮২ সালে মারা যান। এরপর দালি নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হন। তাই পেসমেকার (হৃৎস্পন্দন নিয়মিত রাখতে কৃত্রিম যন্ত্র) লাগাতে হয়। স্ত্রীর মৃত্যুর দুই বছর পর তাঁর বিছানায় আগুন লেগে যায়। গুরুতর দগ্ধ হন তিনি। চিকিৎসায় সুস্থ হলেও প্রায় শয্যাশায়ী অবস্থাতেই ছিলেন। ১৯৮৯ সালের ২৩ জানুয়ারি সকালে এই খ্যাতনামা শিল্পীর প্রাণপ্রদীপ নিভে যায়।

অনেকেই বলেছেন, দালির মৃত্যুর আগে যখন তিনি চেতন-অচেতন অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন, সে সময় তাঁর অভিভাবকেরা শিল্পীকে দিয়ে সাদা ক্যানভাস ও বহু লিথোগ্রাফ কাগজে সই করিয়ে নিয়েছিলেন। ফলে দালির স্বাক্ষর থাকলেও বাজারে চালু থাকা বেশ কিছু চিত্রকলা ও ছাপচিত্র নকল বলে মনে করেন শিল্পকলা-বিশেষজ্ঞরা। তবে নকল কখনো আসলের স্থান স্পর্শ করতে পারবে না। সালভাদর দালি তাঁর কাজের ভেতর দিয়েই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। জন্মদিনে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।