মাইনুল ইসলাম রাজু
বরগুনার আমতলীতে ঘটল এক নীরব প্রশাসনিক বিপ্লব। প্রায় চার দশক ধরে উপজেলা শহরের ভাড়া অফিস থেকে চলা ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম হঠাৎ করেই ফিরে গেল স্ব-স্ব নিজস্ব ইউনিয়ন কমপ্লেক্স ভবনে। এর পেছনে আছেন সদ্য যোগ দেওয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. রোকনুজ্জামান খান। যার ‘অফিসে নয়, জনগণের দোরগোড়ায়’ ভাবনা ইতিমধ্যেই আলোচনায়।
চল্লিশ বছরের অভ্যাস ভাঙল এক ঝটকায়ঃ
আমতলী উপজেলার আয়তন ৩৯৯ বর্গ কিলোমিটার, জনসংখ্যা সোয়া দুই লাখ। রয়েছে ৭ ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভা। ১৯৮০-এর দশকের শুরুতে স্থানীয় নানা অজুহাতে ইউনিয়ন পরিষদ অফিসগুলো সরিয়ে আনা হয় উপজেলা শহরে। তারপর প্রায় ২৫ থেকে ৪০ বছর ধরে স্থানীয় মানুষের পরিচিত দৃশ্য হয়ে ওঠে -সেবা পেতে ইউনিয়নবাসীর দীর্ঘ যাত্রা। উপজেলা থেকে সবচেয়ে দুরের ইউনিয়ন দক্ষিণে হলদিয়া আর উত্তরে আঠারগাছিয়া। ওই দুটি ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়ও উপজেলা শহর থেকে প্রায় ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। তাও নড়বড়ে রাস্তা, দুর্বহ যাতায়াতের পথ পাড়ি দিয়ে উপজেলা শহরে আসতে হত। শুধু একটি প্রত্যয়নপত্র বা নাগরিক সনদের জন্য ব্যয় হত ১০০ থেকে ২৫০ টাকা এবং নষ্ট হত দিনভর সময়।
ধুলো জমে নষ্ট হচ্ছিল ভবনগুলোঃ
ইউনিয়ন পরিষদের জন্য সরকারি অর্থে স্থায়ী ভবন তৈরি হয়েছিল। কিন্তু বছরের পর বছর তালাবদ্ধ হয়ে পড়ে থেকেছে সেগুলো। রং উঠে গেছে দেয়াল থেকে, জানালায় জং, আশেপাশে ঝোপঝাড়। সেইসব ভবন নতুন করে সচল হয়েছে ইউএনও রোকনুজ্জামান খানের উদ্যোগে। এখন ৭টি ইউনিয়ন পরিষদে নিয়মিতভাবে জনপ্রতিনিধিরা আসেন ও স্থানীয়দেরকে তারা সেবা প্রদান করে থাকেন।
ইউএনওর কড়া নির্দেশনাঃ
চলতি বছরের ১৩ মে আমতলীতে ইউএনও হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর মোঃ রোকনুজ্জামান খান প্রথমেই বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এরপর ইউপি চেয়ারম্যান, সদস্য ও কর্মকর্তাদের ডেকে জানান- নিজস্ব ইউনিয়নে কার্যক্রম ফিরিয়ে নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। পত্রপ্রদান, সরেজমিন পরিদর্শন এবং কড়া হুঁশিয়ারির পর জুনের মাঝামাঝি সময়ে বন্ধ থাকা সকল ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের খুলে যায় তালা।
নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের স্বস্তিঃ
আঠারগাছিয়া ইউনিয়নের সংরক্ষিত নারী সদস্য নাজমুন নাহার মুকুল বেগম বলেন, ৪০ বছর পরে ইউনিয়ন পরিষদ আবার ইউনিয়নে ফিরেছে। ভবন থাকলেও এতদিন তালাবদ্ধ ছিল। ইউএনও স্যারের আদেশে সচল হয়েছে ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স।খুলে গেছে বন্ধ থাকা সকল ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের তালা। এখন সেবাগ্রহীতাদের পাশাপাশি ইউপি সদস্যদেরকে সময় আর অর্থ নষ্ট করে উপজেলায় যেতে হয় না।
কুকুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বোরহান উদ্দিন আহমেদ মাসুম তালুকদার ও আঠারগাছিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রিপন বলেন, এটি একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। ইউনিয়ন পরিষদ আবার মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। সেবা ফিরলো জনগনের দোড়গোড়ায়। তারা আরো বলেন, আগে বছরের পর বছর ধরে জনপ্রতিনিধিরা ধারাবাহিকভাবে উপজেলা শহরেই ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। তাতে করে গ্রামের সাধারণ জনগনকে শহরে গিয়ে সেবা নিতে হতো। এখন গ্রামেই তাদেরকে সেবা দেয়া হচ্ছে।
সেবা প্রত্যাশিদের বক্তব্যঃ
সেবা নিতে আসা হলদিয়া ইউনিয়নের উত্তর তক্তাবুনিয়া গ্রামের মোয়াজ্জেম হোসেন হাওলাদার বলেন, আমার জরুরি কাজে একটি পরিচয়পত্র নেয়ার জন্য ইউনিয়ন পরিষদে এসেছি। আগে উপজেলা শহরে গিয়ে আনতে হতো। তখন সময় ও আর্থিক দুটোই নষ্ট হতো। শুনেছি এখন আর আমাদের কষ্ট করে উপজেলা শহরে যেতে হবে না। এখন থেকে চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা আমাদের ইউনিয়নে অবস্থিত ইউপি কার্যালয়ে বসে অফিস করবে। এতে আমাদের মত অসহায় গরীব মানুষের জন্য অনেক উপকার হইছে।
গুলিশাখালী ইউনিয়নের ডালাচারা গ্রামের গৃহবধূ সালমা বেগম বলেন, আগে জন্ম নিবন্ধন করতে মোগো আমতলী উপজেলা শহরে যাওয়া লাগতো। এখন মোরা বাড়ির ধারে ইউনিয়ন পরিষদ বইয়াই হগোল কাম হরতে পারমু। এর লইগ্যা মোগো আমতলীর নতুন ইউএনও স্যারেরে ধন্যবাদ জানাই। তিনি মোগো মতন গরীবের দিকে চাইয়া ইউনিয়নের সাধারণ মানুষের সেবা ইউনিয়নেই ফিরিয়ে দেছেন।
জমে উঠেছে ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন বাজারগুলোঃ বছরের পর বছর ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় পরিষদ সংলগ্ন বাজারগুলোতে থাকা ব্যবসাযীদের বেচা-কেনা একদম ঝিমিয়ে পড়ে ছিলো। অনেক ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গুটিয়ে অন্যাত্র চলে গিয়েছিলেন। এখন আবার ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম উপজেলা সদর থেকে পুনঃরায় ইউনিয়নে ফিরিয়ে দেয়ায় বাজারগুলো বেশ জম-জমাট হয়ে উঠেছে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে তাদের বেচাকেনা।
হলদিয়া ইউনিয়ন পরিষদ কমপ্লেক্স সংলগ্ন বাজারের চা বিক্রেতা সোলায়মান মাতবর বলেন, ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আগে মোগো বাজারটা অন্ধকারে ছিলো। দিনে কিছু লোকজন আসলেও সন্ধ্যার পরে বাজারে কাউকে খুঁজে পাওয়া যেত না। এখন ইউনিয়র পরিষদের কার্যক্রম পুনঃরায় শুরু হওয়ার বাজারটা বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে।
সচেতন মহলের উপলব্দিঃ
আমতলী সদর ইউনিয়নের সেকান্দারখালী গ্রামের শিক্ষক আঃ হাই বলেন, নতুন ইউএনও স্যারকে ধন্যবাদ না জানিয়ে পারছিনা। বিগত ৪০ বছরে যা কেহ করতে পারেনি। তা তিনি আমতলীতে যোগদান করেই করে দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি এক নোটিশে স্ব-স্ব ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রম উপজেলা সদর থেকে পুনঃরায় ইউনিয়নে ফিরিয়ে দিয়েছেন। তিনি আরো বলেন, এখন বছরের পর বছর বন্ধ থাকা ইউনিয়ন পরিষদগুলো সাধারণ মানুষের পদচারনায় বেশ জমজমাট হয়ে উঠেছে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনওর) বক্তব্যঃ
ইউএনও মোঃ রোকনুজ্জামান খান বলেন, সরকারি বিধি মেনে কাজ করলেই সেবা সহজলভ্য হয়। এতদিনে অনেক তরুণ তাদের ইউনিয়নে ইউনিয়ন পরিষদ দেখেনি। অথচ তাদের সেবা নিজ নিজ ইউনিয়ন থেকে পাওয়া তাদের অধিকার।জনপ্রতিনিধিরা সকলেই শহরমুখী। তাই শহরেই তারা এতো বছর ধরে অস্থায়ী কার্যালয় পরিচালনা করে আসছিল। এখন সবাই তাদের নিজস্ব কার্যালয়ে ফিরে গেছেন। ফলে সেবা গ্রহীতাদেরকে আর শহরে আসতে হবে না।
চল্লিশ বছরের প্রথা ভাঙার পর এই প্রশাসনিক সংস্কার এখন আমতলীতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।