সিলেট মুরারি চাঁদ কলেজ: ইতিহাসের এক অধ্যায় – BANGLANEWSUS.COM
  • নিউইয়র্ক, রাত ৪:১৪, ১০ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ


 

সিলেট মুরারি চাঁদ কলেজ: ইতিহাসের এক অধ্যায়

newsup
প্রকাশিত জুলাই ৪, ২০২৫
সিলেট মুরারি চাঁদ কলেজ:  ইতিহাসের এক অধ্যায়

Manual4 Ad Code

সংগ্রাম দত্ত

পূণ্যভুমি সিলেটের বহু ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক সিলেট নগরীর পূর্বপ্রান্তে স্বমহিমায় অধিষ্ঠিত উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন বিদ্যাপীঠ‘কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল’ মুরারিচাঁদ কলেজ। যা’ সিলেট বিভাগের মধ্যে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে পরিচিত ১৩৪ বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে অগনিত জ্ঞানী ও গুণীর সূতিকাগার এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

Manual7 Ad Code

মুরারিচাঁদ কলেজ সাধারণত এমসি কলেজ নামে সকলের কাছে পরিচিত। বাংলাদেশের একটি উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এটি সিলেট বিভাগীয় শহরের টিলাগড় এলাকায় অবস্থিত এবং বৃহত্তর সিলেটের সবচেয়ে পুরাতন ও শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠাকালের দিক দিয়ে এটি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত কলেজগুলোর মধ্যে ৭ম। এই ঐতিহ্যবাহী কলেজটি ১৮৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়।

মুরারিচাঁদ কলেজ ১৮৯২ সালে তৎকালীন সিলেটের প্রখ্যাত শিক্ষানুরাগী রাজা গিরীশচন্দ্র রায় (ব্রজগোবিন্দ নন্দী চৌধুরী) -এর অনুদানে প্রতিষ্ঠিত হয় । কলেজটির নামকরণ করা হয় তাঁর মাতামহ মুরারিচাঁদ-এর নামে। পূর্বে কলেজটি সিলেটের বন্দর বাজারের নিকট রাজা জি. সি. উচ্চ বিদ্যালয় এর পাশে অবস্থিত ছিল।
১৮৯১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজটিতে এফ. এ. ক্লাস খোলার অনুমতি দিলে ১৮৯২ সালের ২৭ জুন আনুষ্ঠানিকভাবে মুরারিচাঁদ কলেজের যাত্রা শুরু হয়। সে সময় ছাত্রদের বেতন ছিল ৪ টাকা এবং ১ম বিভাগে এন্ট্রান্স পাশকৃতদের জন্য বিনা খরচে পড়ার ব্যবস্থা ছিল।

Manual3 Ad Code

১৮৯২ সাল থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত রাজা গিরীশচন্দ্র রায় নিজেই কলেজটির সকল ব্যয়ভার বহন করেন। ১৯০৮ সালে রাজা পরলোকগমন করলে কলেজটি সরকারি সহায়তা প্রার্থনা করে। তখন থেকে কলেজটি সরকারি সহায়তায় পরিচালিত হতে থাকে। এরপর ১৯১২ সালে কলেজটি পূর্ণাঙ্গ সরকারি কলেজ রূপে আত্মপ্রকাশ করে। একই বছর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের আসাম প্রদেশের চিফ কমিশনার স্যার আর্চডেল আর্ল কলেজটিকে ২য় শ্রেণির কলেজ থেকে ১ম শ্রেণির কলেজে উন্নীত করেন ।

১৯১৩ সালে কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক বিজ্ঞান ক্লাস চালু হয়। পরবর্তীকালে জননেতা আব্দুল মজিদ (কাপ্তান মিয়া) সহ আরও অনেকে মিলে ১৮০০০ টাকা অনুদান দিলে কলেজটিতে স্নাতক শ্রেণি চালু হয়।

১ম বিশ্বযুদ্ধ ও অন্যান্য নানা সমস্যার কারণে কলেজের ক্যাম্পাস পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখা দেয়। তখন কলেজ থেকে ৩ কি. মি. দূরে থ্যাকারে টিলায় (বর্তমান টিলাগড়) ১২৪ একর ভূমি নিয়ে বিশাল ক্যাম্পাসে কলেজ স্থানান্তর করা হয়। সে সময় কলেজের ছাত্রসংখ্যা ছিল ৫৬৮ জন।

১৯২১ সালে তৎকালীন আসামের শিক্ষা মন্ত্রী খাঁন বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদের (কাপ্তান মিয়া) নেতৃত্বে ক্যাম্পাসটি স্থানান্তরিত করে টিলাগড়ের থ্যাকারে টিলায় আনা হয়।

১৯২১ সালে তৎকালীন আসামের গভর্নর স্যার উইলিয়াম মরিস কলেজের নতুন ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

১৯২৫ সালে ভবন নির্মাণ সম্পন্ন হলে তা উদ্বোধন করেন তৎকালীন আসামের গভর্নর স্যার উইলিয়াম রীড।

১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পূর্ব পর্যন্ত কলেজটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। দেশ বিভাগের পর এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আসে। পরবর্তীকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে ১৯৬৮ সালে কলেজটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হয় এবং সর্বশেষ ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ এর মত মুরারিচাঁদ কলেজটিকেও বাংলাদেশ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর অধিভুক্ত করা হয় এবং অদ্যাবধি রয়েছে।

সিলেট মুরারি চাঁদ কলেজের ইতিহাসের এক মহান নায়ক সৈয়দ আব্দুল মাজিদ (কাপ্তান মিয়া) ।

১৮৯৭ সালের বিরাট ভূমিকম্পের ফলে রাজার বাড়ি ঘর ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহ ধ্বংস হয়ে যায়। তিনি ঋণ গ্রহণ করে তা পুনর্নির্মাণ করতে যেয়ে ধীরে ধীরে আর্থিক অনটনে পতিত হন। ১৯০৮ সালে রাজা গিরিশ চন্দ্রের মৃত্যুর পর এইডেড প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। বাবু দুলাল চন্দ্র দেব এবং কাপ্তান মিয়ার উদ্যোগে কলেজটি নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায়। সেই সময় মুরারিচাঁদ কলেজ সিলেট শহরের ভিতর ছিল এবং প্রথম শ্রেণীর ডিগ্রি কলেজের উপযুক্ত পরিবেশ এবং দালান কোঠা সেখানে ছিলনা। তৎকালীন সময়ে সিলেটের জনপ্রিয় নেতা খান বাহাদুর সৈয়দ আব্দুল মজিদ কাপ্তান মিয়া শহর থেকে তিন মাইল দূরে ১২০ একর জমি অধিগ্রহণ করে বর্তমান মুরারিচাঁদ কলেজ প্রাঙ্গণের ভিত্তির সূচনা। কাপ্তান মিয়া কলেজের নতুন কোনো নাম বা নিজের নাম না দিয়ে এই নতুন প্রাঙ্গণে কলেজটিকে মুরারিচাঁদ কলেজের নামই রাখেন। রাজা গিরিশ চন্দ্রে যে বীজ বপন করেছিলেন কাপ্তান মিয়া সেটাকে মহীরুহুতে পরিণত করেন। বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ১৯১৯ সালে সিলেট আগমন করলে তাঁকে যে বিরাট সংবর্ধনা দেয়া হয়, সৈয়দ আব্দুল মজিদ কাপ্তান মিয়া ছিলেন সেই অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি।

১২৪ একর ভূমির উপর অবস্থিত মুরারিচাঁদ কলেজের সুবিশাল ক্যাম্পাসে রয়েছে একটি ক্যান্টিন, একটি মসজিদ, ছাত্র-ছাত্রীদের আবাসিক হোস্টেল, বিভিন্ন বিভাগীয় ভবন এবং একটি খেলার মাঠ রয়েছে। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এঁর ম্যুরাল রয়েছে। নতুন করে নির্মিত হয়েছে সৈয়দ আব্দুল মজিদ কাপ্তান মিয়া এঁর ম্যুরাল। ক্যাম্পাসের পূর্বে রয়েছে সিলেট সরকারি কলেজ এবং উত্তরে রয়েছে সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ। এছাড়াও কলেজের পাশেই রয়েছে টিলাগড় ইকো পার্ক। কলেজের ভিতরে একটি পুকুরও রয়েছে।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ভালো ফলের ধারাবাহিকতায় মুরারিচাঁদ কলেজ অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেছে। শিক্ষার্থীরা যেন ভালো শিক্ষার্থীর পাশাপাশি মানবিক মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠেন সেদিকে কলেজ কর্তৃপক্ষের নজরে থাকে। শিক্ষার্থীরা যেন পড়াশোনাসহ সব দিক দিয়েই পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারেন, সে পাঠই শিক্ষকেরা প্রদান করে থাকেন। এ ছাড়া সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শিক্ষার্থী নিজের প্রয়োজনকে বুঝতে পারেন, দেশপ্রেমী হয়ে গড়ে উঠতে পারেন। তাই সহশিক্ষা কার্যক্রমকে শিক্ষকরা নিয়মিত উৎসাহ প্রদান করেন। পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্যান্য বই পড়তেও শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করেন। কলেজ বার্ষিকী ও জার্নাল প্রকাশের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের সৃষ্টিশীল ও মননশীল প্রতিভার বিকাশেও নিয়মিত উদ্যোগ নেওয়া হয়। উচ্চমাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর পর্যন্ত সব পর্যায়ে শিক্ষকরা মান ধরে রাখতে চেষ্টা করেন। এখন আর লেকচার–নির্ভর ক্লাসে শিক্ষার্থীরা আগ্রহী নন, তাই শ্রেণিকক্ষ আধুনিক প্রযুক্তিতে সাজানো হয়েছে।

Manual1 Ad Code

বর্তমানে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণিসহ স্নাতক, স্নাতকোত্তরে ষোলটি বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্সে অধ্যয়নরত ১৫ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর কলরবে মুখরিত, তাদের লালিত প্রজ্ঞা ও মেধাকে সঙ্গে নিয়ে মুরারিচাঁদ কলেজ পরিবার বিশ্বমানের শিক্ষায় বিকশিত ।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এফ.এ কোর্স চালুর মাধ্যমে মুরারিচাঁদ কলেজের শুভ সূচনা। আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় শিক্ষার মান উন্নয়ন ও শ্রেণিশিক্ষা কার্যক্রম সুষ্ঠু ও কার্যকরভাবে পরিচালনার জন্য এ প্রতিষ্ঠানটি তার জ্ঞান ও গরিমার ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণি থেকে স্নাতকোত্তর শ্রেণি সকল ক্ষেত্রে ডিজিটাল পদ্ধতিতে শ্রেণিশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে এবং ইতোমধ্যে উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পৃথক ডিজিটাল শ্রেণিকক্ষের প্রবর্তন এবং মাল্টিমিডিয়া প্রকেক্টরের মাধ্যমে শ্রেণিশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। মুরারিচাঁদ কলেজের শিক্ষার্থীরা উচ্চারণমাধ্যমিক শ্রেণি থেকে স্নাতক(পাস), স্নাতক(সম্মান), স্নাতকোত্তর সকল পর্যায়ে ফলাফলের কৃতিত্বে প্রতিষ্ঠানটির গৌরবোজ্জল ঐতিহ্যকে সমুন্নত রেখে অগ্রসর হচ্ছে। শিক্ষা,সাহিত্য, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সাফল্যের অবিরাম ধারাকে অব্যাহত রাখতে মুরারিচাঁদ কলেজের শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের সত্য, সুন্দর ও মঙ্গলের আলোকবর্তিকা শিক্ষার পরিবেশে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে, জ্ঞানচর্চার পরিবেশ আরো উন্নত হবে,শিক্ষার্থীরা সৃষ্টিশীল ও কল্যাণময়ী ব্রতে জেগে উঠবে এই প্রত্যাশা সকলের।

সিলেটের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশে নগরের টিলাগড় এলাকায় ১২৪ একর জায়গার ওপর অবস্থিত এ কলেজের লাইব্রেরিতে আছে প্রায় ৬০ হাজার বই। এখানে একটি করে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও জুলজিক্যাল মিউজিয়াম আছে। সহশিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে অন্তত ২০টি সংগঠন। মোট শিক্ষার্থী প্রায় সাড়ে ১৩ হাজার। উচ্চমাধ্যমিকের পাশাপাশি এখানে স্নাতক (পাস), ১৫টি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) ও ১৬টি বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়ানো হয়। শিক্ষক আছেন ১৩০ জন।

Manual2 Ad Code

এমসি কলেজের প্রথম এবং পুরাতন সংগঠনগুলির মধ্যে রয়েছে মোহনা সাংস্কৃতিক সংগঠন।
বাংলাদেশ স্কাউটস দ্বারা পরিচালিত ৩টি রোভার ইউনিট এবং ১টি গার্ল ইন-রোভার ইউনিট রয়েছে । বাংলাদেশ জাতীয় ক্যাডেট কর্পসের ময়নামতি ব্যাটালিয়নের এখানে একটি প্লাটুন রয়েছে।

১৪ নভেম্বর ২০১৭ তারিখে, মুরারী চাঁদ বিতর্ক সমিতি (এমসিডিএস) প্রতিষ্ঠিত হয়। ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের বিতর্ক চ্যাম্পিয়নশিপ ২০১৮-তে সিলেট বিভাগের মধ্যে এমসিডিএস প্রথম স্থান অর্জন করে। অন্যান্য কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে মুরারী চাঁদ কলেজ প্রেস ক্লাব, মুরারী চাঁদ কবিতা পরিষদ, ধ্রুবক ক্লাব, ট্যুরিস্ট ক্লাব, থিয়েটার মুরারী চাঁদ, সাংস্কৃতিক সংগঠন, রসায়ন ক্লাব, বোটানিক্যাল সোসাইটি এবং অর্থনীতি ক্লাব।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।
Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code