তোমাকে অভিবাদন জেসিন্ডা – BANGLANEWSUS.COM
  • নিউইয়র্ক, সন্ধ্যা ৬:৪৯, ৩০শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ


 

তোমাকে অভিবাদন জেসিন্ডা

প্রকাশিত মার্চ ২২, ২০১৯
তোমাকে অভিবাদন জেসিন্ডা

Manual8 Ad Code

ছোটবেলায় বাড়িতে ডেইরি মিল্ক আসত। নিউজিল্যান্ডের ডেইরি মিল্ক। সেই থেকে নিউজিল্যান্ড নামটি মাথায় গেঁথে আছে। পরে টিভিতে প্রচারিত বিজ্ঞাপন দেখে জিঙ্গেল রপ্ত হয়, দুধের দেশ নিউজিল্যান্ড।

 

একটু বড় হয়ে ক্রিকেটের সুবাদে নিউজিল্যান্ড নামটি নতুন করে শেখা। উঁহু, কিইউ পেসারদের কী আগুনঝরা বল! স্পিনারদের ঘূর্ণিও চোখে ধুলা দেয়। ব্যাটসম্যানরা ধুমছে হাঁকান চার-ছক্কা।

 

সাধারণ জ্ঞান পড়তে গিয়ে জানলাম, নিউজিল্যান্ড শান্তির দেশ। সে অনেক আগের কথা। বহু বছর পেরিয়ে গেলেও দেশটির শান্তিপূর্ণ অবস্থার বদল হয়নি। বৈশ্বিক শান্তি সূচক (জিপিআই) ২০১৮ অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে শান্তির দেশের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে নিউজিল্যান্ড।

 

কয়েকজনের কাছে শুনেছি। টিভিতে অল্পবিস্তর দেখেছি। আর ইউটিউব-গুগল তো আছেই। এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সুদূর নিউজিল্যান্ড সম্পর্কে আমার ধারণা হলো, দেশটি অপরূপ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ দেশটি ছবির মতো সাজানো। কবেই মন স্থির করেছি, জীবনে একবার হলেও ঘুরতে যাব। তবে এখন পর্যন্ত যাওয়া হয়নি।

 

ডেইরি মিল্ক, ক্রিকেট, শান্তি, প্রকৃতি—এসবের বাইরে আমার মাথায় নিউজিল্যান্ড নামটা খুব একটা আসে না।

 

তবে হ্যাঁ, দেড় দশকেরও বেশি আগে এক মর্মান্তিক ঘটনায় নিউজিল্যান্ড নামটি বারবার সামনে এসেছিল। ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশটির ক্রাইস্টচার্চ শহরে ৬ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে। ভূমিকম্পে ১৮৫ জন লোক নিহত হন।

 

ক্রাইস্টচার্চ শহরটা বেশ সুন্দর বলেই জানি। সেখানে যখন ক্রিকেট খেলা চলে, তখন টেলিভিশনের বদৌলতে প্রকৃতি দেখারও সুযোগ মেলে। চোখ জুড়িয়ে যায়। অচেনা-অদেখা শহরটাকে কেন যেন চেনা-চেনা লাগে। কী জানি!

 

Manual5 Ad Code

আট বছর আগে ক্রাইস্টচার্চ প্রকৃতির ধ্বংসলীলায় থমকে গিয়েছিল। ভূমিকম্পের ধ্বংসাত্মক স্মৃতি হারিয়ে যেতে না যেতেই এখন আরেক ভয়ংকর ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে ক্রাইস্টচার্চ।

 

এক সপ্তাহ আগে, গত শুক্রবার জুমার নামাজের সময় ক্রাইস্টচার্চের আল নুর মসজিদ ও লিনউড মসজিদে মুসল্লিদের ওপর বন্দুকধারী নির্বিচারে গুলি চালায়। গুলিতে পাঁচ বাংলাদেশিসহ ৫০ জন নিহত হন। আহত ৪২ জন।

 

ঠান্ডা মাথায় হামলাকারী বন্দুকের নল তাক করে একে একে যেভাবে মানুষ হত্যা করেছেন, যে হিংস্রতা, যে নৃশংসতা তিনি দেখিয়েছেন, তা সব বীভৎসতাকে হার মানায়। নিরীহ, নামাজ আদায়রত মুসলিম হত্যার এই দৃশ্য ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সারা বিশ্বের মানুষের বিবেক নাড়িয়ে দিয়েছে। বুকের গহিনে কষ্ট দলা পাকিয়ে গোঙানি করে যাচ্ছে। কারও-বা চাপা আবেগ হু হু করে কান্না হয়ে বেরিয়ে আসছে।

 

ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে হামলা পুরো নিউজিল্যান্ডকেই বদলে দিয়েছে। সেই সঙ্গে এই হামলার ঘটনার পর আমরা এক মানবিক, অসাম্প্রদায়িক, বলিষ্ঠ কণ্ঠের বিশ্ব নেতার আবির্ভাব লক্ষ করলাম। তিনি নিউজিল্যান্ডের তরুণ প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আহডার্ন। হামলার পর তাঁর ন্যায়নিষ্ঠ, জোরালো ভূমিকা বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে তিনি সবার হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প, ভ্লাদিমির পুতিন, সি চিন পিং, থেরেসা মে, আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মতো বাঘা বাঘা নেতাকে পেছনে ফেলে জেসিন্ডাই এখন আশার আলো। তিনি মানবিক পৃথিবীর প্রতিনিধি।

 

নিউজিল্যান্ডের রাজনীতি নিয়ে আমাদের আগ্রহ না থাকাটাই স্বাভাবিক। তাই দেশটিতে কে প্রধানমন্ত্রী হলেন, সে বিষয়ে আমাদের মাথাব্যথা থাকার কথা নয়। তবে জেসিন্ডার কথা আলাদা।

 

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে নিউজিল্যান্ডে সাধারণ নির্বাচন হয়। নির্বাচনে ৩৭ শতাংশেরও কম ভোট পায় জেসিন্ডার লেবার দল। তা সত্ত্বেও তিনি অন্যদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করতে সক্ষম হন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে শপথ নেওয়ার মধ্য দিয়ে জেসিন্ডা বিশ্বের সর্বকনিষ্ঠ নারী প্রধানমন্ত্রী হন।

 

জেসিন্ডার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খবর বিশ্ব গণমাধ্যমে আসে বটে, তবে তা নিয়ে খুব একটা হইচই হতে দেখা যায়নি। তবে প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডার মা হওয়ার খবর ঠিকই আলোড়ন তোলে।

 

Manual6 Ad Code

২০১৮ সালের জানুয়ারিতে জেসিন্ডা ঘোষণা দেন, তিনি মা হতে যাচ্ছেন। একই বছরের জুনে কন্যাসন্তান জন্ম দেন তিনি। জেসিন্ডা আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে দ্বিতীয় সরকারপ্রধান, যিনি প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে মা হয়েছেন। সংগত কারণেই এ নিয়ে ছিল সবার আগ্রহ।

 

গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রথমবারের মতো জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেন জেসিন্ডা। তবে কন্যাসন্তানকে সঙ্গে নিয়ে অধিবেশনে গিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন তিনি। বুঝিয়ে দেন, নিজের শক্তিশালী ব্যক্তিত্ব ও গর্বের মাতৃত্বের মহিমা। এ নিয়ে বিপুল বাহবা কুড়ান জেসিন্ডা।

 

ক্রাইস্টচার্চে মসজিদে হামলার ঘটনার পর আমরা জেসিন্ডাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করি। কঠোরতম ভাষায় হামলার নিন্দা জানান তিনি। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী হামলাকারীর মন দেখেননি, রং দেখেননি। হামলাকারীকে সন্ত্রাসী বলতে জেসিন্ডা একটুও সময় নেননি, দ্বিধা করেননি।

Manual7 Ad Code

আহত ব্যক্তিদের কাছে, নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের কাছে, মুসলমান কমিউনিটির সদস্যদের কাছে বারবার ছুটে গেছেন জেসিন্ডা। তাঁদের বুকে জড়িয়ে ধরেছেন, কেঁদেছেন, কখনো হতবিহ্বল হয়ে থেকেছেন। মুসলমানদের সঙ্গে সমানুভূতি ও একাত্মতা প্রকাশে জেসিন্ডা শোকের পোশাক গায়ে জড়িয়েছেন। পরেছেন হিজাব। শোক শুধু তাঁর পোশাকে ছিল না, ছিল মুখমণ্ডলে, চাহনিতে, মনে।

 

নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী স্পষ্টভাবে বলেছেন, হামলার ঘটনায় তাঁর দেশের ইতিহাস যেমন বদলে গেছে, তেমনি বদলে যাচ্ছে আইন। এই প্রেক্ষাপটে অস্ত্র আইন সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন তিনি।

Manual4 Ad Code

 

মুসলমানদের আস্থায় নিতে জেসিন্ডা সম্ভাব্য সবকিছুই করে যাচ্ছেন। তিনি ইতিমধ্যে দেখিয়ে দিয়েছেন, তাঁর দেশের মুসলমানরা বিচ্ছিন্ন, সংখ্যালঘু বা আলাদা কোনো গোষ্ঠী নয়। তাঁরা মূলধারারই অংশ। নিউজিল্যান্ডে থাকা মুসলমান সম্প্রদায়ের রক্তক্ষরণ হলে পুরো দেশেরই রক্তক্ষরণ হয়। মুসলমানদের অভয় দিয়ে, আস্থায় নিয়ে জেসিন্ডা মূলত পুরো দেশকেই ঐক্যবদ্ধ করেছেন।

 

সন্ত্রাসী হামলার শিকার ক্রাইস্টচার্চের মসজিদ দুটি আজ আবার খুলেছে। রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ও রেডিওতে পবিত্র জুমার নামাজের আজান সম্প্রচার করা হয়েছে। মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেছেন মুসল্লিরা। এ ছাড়া আজ দেশটিতে জাতীয়ভাবে পালন করা হয় দুই মিনিটের নীরবতা।

 

বিশ্বে কত দেশই তো আছে। আছে রথী-মহারথী ধাঁচের নেতা। কই, কাউকে তো জেসিন্ডার মতো দেখলাম না।

 

ট্রাম্প-মোদিদের এই জমানায় জেসিন্ডা বিপরীত স্রোতের মাঝি। তিনি অনন্য। তাঁকে অভিবাদন।

 

 

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।
Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code