বঙ্গবন্ধুর আত্নত্যাগ ও বর্তমান বাংলাদেশ - BANGLANEWSUS.COM
  • নিউইয়র্ক, রাত ৯:০৪, ৯ই সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ


 

বঙ্গবন্ধুর আত্নত্যাগ ও বর্তমান বাংলাদেশ

banglanewsus.com
প্রকাশিত নভেম্বর ১৪, ২০২২
বঙ্গবন্ধুর আত্নত্যাগ ও বর্তমান বাংলাদেশ

আবুল কাশেম উজ্জ্বল :: স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে একটি জাতিকে স্বাধীনতা উপহার দিয়েছিলেন। কেবল স্বাধীনতা নয়, প্রায় ধ্বংস প্রাপ্ত একটি দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার মাধ্যমে দেশকে আবারো সচল ও স্বাভাবিক করতে নিজের সময়, শ্রম, মেধা, সবই বিলিয়ে দিয়েছিলেন। শৈশব থেকে যে মানুষটি দেশের মানুষের জন্য কাজ করেছেন, গণমানুষের হাসি যাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে; আবার তাদের কান্না তাঁকে বিমর্ষ করেছে। জীবনভর তিনি কাজ করেছেন, স্বপ্ন দেখেছেন- একটি স্বাধীন, স্বনির্ভর ও বৈষম্যহীন সমাজের। দেশ নিয়ে, মানুষ
নিয়ে, সমগ্র বিশ্ব নিয়ে চিন্তা-চেতনার গভীরতার কিছু নমুনা দেখা যায় তাঁর লেখনিতে।
অসমাপ্ত আত্নজীবনী বা কারাগারের রোজনামচাসহ অন্যান্য রচনায় বার বার উঠে এসেছে তাঁর বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা, আদর্শ, নৈতিক মূল্যবোধ, স্বদেশ-ভাবনা। জনগণের আয়নায় নিজেকে দেখেছেন বলেই অন্যদের থেকে নিজেকে আলাদা করে দেখেননি। ফলে বাংলার মানুষ তাঁকে ভালবেসে স্বাধীনতা যুদ্ধে এক হয়ে তাঁর নির্দেশনায় যুদ্ধ করেছে। আবার স্বাধীন বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য তাঁকেই নেতা মেনে নিয়েছিল, কোন বিতর্ক ছাড়া। তাঁর রাজনৈতিক জীবন নিয়ে বছরের পর বছর গবেষণা করলেও অনেক কিছু অজানা থেকে যাবে। মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে তিনি যেভাবে মানুষের জন্য ও মানুষের হয়ে কাজ করেছেন, নিজের পরিবার-পরিজনদের কথা না-ভেবে বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন, তা বর্তমানে প্রায় অকল্পনীয়। তাঁর জীবনে ৪৬৮২ দিন কারাভোগ করেছেন যার শুরু ব্রিটিশ আমলে স্কুলজীবনে ৭ দিন কারাবরণ করে। বাকি ৪৬৭৫ দিন কারা ভোগ করেছেন পাকিস্তান সরকারের আমলে। ৫৫ বছরের জীবনের প্রায় এক-চতুর্থাংশ সময় কারাগারেই কাটাতে হয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে। পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে বঙ্গবন্ধু ১৮ বার জেলে গেছেন এবং মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন দুবার। বর্তমান সময়ে এমন ক’জন আছি, যারা দেশের জন্য জীবনের এক-তৃতীয়াংশ জেলে থাকব? বরং অপরাধ প্রমাণিত হওয়ার পরও অনেকে জেলে না থেকে নানা অজুহাতে হাসপাতালে আরামে থাকার চেষ্ঠা করেন। আবার অনেক জেলে যাওয়ার আগেই ‘ডিভিশন’ নিশ্চিত করতে আইনী ব্যবস্থা নেন। আর বঙ্গবন্ধুকে থাকতে হয়েছিল কারাগারের সবচেয়ে কষ্টকর কামরাগুলোতে।
রাজনৈতিক জীবনে তিনি কেবল ছুটে চলেছেন। নিজের বা পরিবারের জন্য কাজ করার সুযোগই ছিল না। বরং বাবা বা বঙ্গমাতার কাছ থেকে টাকা নিয়ে তিনি রাজনীতি করেছেন। নিজের সন্তানেরা কি খাচ্ছে, বিদ্যালয়ে ঠিকভাবে যেতে পারছে কি-না, তা নিয়ে ভাবার সুযোগ কমই পেয়েছেন। তাঁর চেতনায় ছিল তাঁর সন্তানেরমত দেশের হাজার-লক্ষ সন্তানের মৌলিক চাহিদা পূরনের স্বপ্ন। ফলে তিনি বর্তমান সময়ের নেকেরমত স্বার্থপর হতে পারেননি। আমরা কিএকবারও ভেবেছি, তাঁর পরিবারের সে সময়ের সীমাহীন সংগ্রাম, অনিশ্চয়তা আর অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতার কথা? মনে হয়, খুব কমই আমরা সে অনুভূতি লালন করতে পারছি। ফলে আমাদের চেতনা আজ ভিন্ন, সম্পদেরেোহ আজ আমাদের কাছে নৈতিকতা। বিবাহিত জীবনের উল্লেখযোগ্য সময় রাজনীতির জন্য তিনি হয় ঘরের বাইরে বা জেলখানায় ছিলেন। এক মামলা থেকে মুক্ত হতে না হতেই, নতুন মামলায় আবার জেলে যেতে হয়েছে। আজকের সময় অনেক বড় বড় অপরাধীরাও জেলে যাওয়ার ভয়ে থাকেনা। আর তাঁর মত নিরপরাধ একজন দেশপ্রেমিককে জেলে যাওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হত। সন্তানরা ছিলেন ‘বাবার’ আদর-স্নেহ বঞ্চিত, অবুঝ সন্তানরা ভাবত জেলই তাদের বাবার বাড়ী। এ রকম নিদারুন কষ্টের কিছু অনুভূতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু লিখেছিলেন, “একদিন সকালে আমি ও রেনু বিছানায় বসে গল্প করছিলাম, হাচু ও কামাল নিচে খেলছিল। হাচু মাঝে মাঝে খেলা ফেলে আমার কাছে আসে আর “আব্বা আব্বা” বলে ডাকে..কামাল চেয়ে থাকে, এক সময় কামাল হাচিনাকে বলছে, হাচু আপা, হাচু আপা, তোমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি….! তাইতো বঙ্গবন্ধু আক্ষেপ করে লিখেছেন, “নিজের ছেলেও অনেক দিন না দেখলে ভুলে যায়।”
দেশের জন্য জীবনের মূল্যবান প্রায় সব কিছু উৎসর্গ করলেও তিনিও ছিলেন একজন বাবা। সন্তানদের জন্য তাঁর মায়া ও আকুতি ছিল, হয়ত অনেক কিছু ভেবে তা প্রকাশ করতেন না। সেই আকুতি বুঝা যায় তাঁর কথায় (অসমাপ্ত আত্নজীবনী:১৬৪), “ছেলেমেয়েদের জন্য যেন একটু বেশি মায়া হয়ে উঠেছিল। ওদের ছেড়ে যেতে মন চায় না, তবু তো যেতে হবে।”
সম্পদের মোহ পরিত্যাগ করে চলেছেন বিধায় তিনি আজ বঙ্গবন্ধু। ব্যক্তিগত জীবনে যেমন ছিলেন অত্যন্ত অনারম্বর, তেমনি পরিবারের জন্যও একই আদর্শ রেখে গেছেন। আজ পত্রিকার পাতা উল্ঠালেই দেখা যায় মালেশিয়া বা কানাডায় পরিবারের জন্য নিরাপদ বাড়ী ও সম্পদের পাহাড় রয়েছে বর্তমান সময়ের অনেক রাজনীতিক, আমলাসহ অনেকের। সময় পেলেই এরাই আবার নিজেদের বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে বড় আদর্শের সৈনিক বলে দাবী করেন। অথচ বঙ্গবন্ধু পরিবারের জন্য কি রেখে গেছেন? সম্পদ নয়, আদর্শ আর বাংলার মানুষের জন্য আত্নত্যাগের অম্লান স্মৃতি।
দেশে এখন যে সংকট চলছে তাতে নিম্ন ও মধ্যবিত্তের সংকট চরমে। একই সময়ে দেখা যাচ্ছে কারো কারো বৈধ-অবৈধ সম্পদের পাহাড়। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারি বা গাড়ির চালকের কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের খবর নতুন নয়, প্রায় নৈমিত্তিক খবর। সে তালিকায় আছেন রাজনীতিক ও সরকারি চাকুরেদের নাম। দুর্নীতি ও অনিয়মের সাথে জড়িতদের বেশীরভাগই ক্ষমতাসীন দলের তকমাধারী। দেশে যে একটা পুঁজিবাদী শ্রেণীর আবির্ভাব হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা যাদের কারণে সংকটের সময়েও সংকট আরো ঘনীভূত হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু নিজেই বলেছেন, ”এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যতদিন দুনিয়ায় থাকবে ততদিন দুনিয়ার মানুষের ওপর শোষণ বন্ধ হতে পারে না।”
আজ পদ-ভারে কিছু মানুষ নিজেকে ভিন্ন ভাবছেন, অথচ কন্ঠে আছে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের গান।
সম্পদ আর ক্ষমতার মোহ তাদের মানসিকভাবে পঙ্গু করে দিয়েছে। তাদের কোন জাত-পাত নেই, এরা সর্বগ্রাসী। তাদের চরিত্র তরল পদার্থের ন্যায়, সব পাত্রেই জায়গা করে নেয়। আবার গিরগিটিরন্যায় সময়ের সাথে এরা চেহারাও বদল করতে পারে। আজ নিত্যপণ্যের বাজার থেকে শুরু করে প্রায় সবক্ষেত্রেই তাদের হাতে সাধারণ মানুষ জিম্মি। তাদের মুখে বঙ্গবন্ধু, কিন্তু বাস্তবে এরা লুঠেরা। এই সর্বগ্রাসীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের অবস্থান নেয়া এখন সময়ের দাবি। দুর্নীতি
প্রতিরোধ করতে পারলে সরকারের ব্যয় যেমন কমবে, তেমনি সাধারণ মানুষের জীবনে স্বস্থিও
আসবে। এরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ও আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত, কিন্তু এরাই সবচেয়ে বেশী সুবিধাভোগী। বেঁচে থাকলে বঙ্গবন্ধু এ শ্রেণীর মানুষগুলোকে অনেক আগেই শায়েস্তা করতেন। বর্তমান সরকারের কাছে কি এ প্রত্যাশা করা অযৌক্তিক?

শিক্ষক, সমাজকর্ম বিভাগ
শাবিপ্রবি, সিলেট

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।