চণচল বাশার ::: সারা দুনিয়ার হাজার বছরের অন্যতম শ্রেষ্ট কবি ও কথাসাহিত্যিক পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেলেন। রবীন্দ্রনাথের পর বাংলাসাহিত্যের একমাত্র বড় কবি ও কথাসাহিত্যিক যিনি নোবেল পাওয়ার মত সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন তিনি হলেন আল মাহমুদ। ছোট দেশ, আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রায়-গুরুত্বহীন ভাষা, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ সাহিত্যিক যোগাযোগ, এছাড়া এই অঞ্চলের নষ্ট রাজনীতির ফলাফল আল মাহমুদকে দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে।
আল মাহমুদকে শিল্পের মাপকাঠিতে মাপলেও তাঁর ভাষা ও নন্দনের ধারেকাছে বাংলা ভাষায় হাতেগোনা। নদীর ঢেউয়ের মত কবুল বলা কিংবা ঠাণ্ডা ও গোলগাল চাঁদ যে কবিতার ভাষায় নান্দনিকভাবে স্থান পেতে পারে তা করে দেখিয়েছেন আল মাহমুদ! এছাড়া তাঁর কাব্য ও গদ্যে এই অঞ্চলের নারী-নদী-যৌনতা এক অসামান্য রূপে ধরা দিয়েছে।
আর রাজনীতির প্রশ্নেও তিনি চিরদিন এক লড়াকু মুক্তিযোদ্ধা। নজরুল যেমন একাই একটি জাতিগোষ্ঠীকে জাগিয়ে দিয়েছিলেন তেমন করে আল মাহমুদ এই অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর একাই প্রতিনিধিত্ব করছেন। জীবনানন্দ যেখানে বৃহত্তর মিডলক্লাশের প্রিয় কবি সেখানে আল মাহমুদ আপামর জনতার প্রিয়তর কবি। শত শত বছরের ব্রাহ্মণ্যবাদী চিন্তাধারার সাহিত্যের মূলে তিনি কুঠারাঘাত করেছেন। লিখেছেন, “ আমাদের ধর্ম হোক ফসলের সুষমবণ্টন” এর মত অসামান্য বাক্য। তিনি শ্রেণীর উচ্ছেদ চেয়ে একটি ’সারা বাংলাদেশ’ আকাঙ্ক্ষা করেছেন । দীর্ঘবছর ধরে চলতে থাকা কাশ্মীর কিংবা প্যালেস্টাইনের মত বর্তমান দুনিয়ার মুক্তিকামী জনতার কথা তাঁর কলমের কালিতে স্থান পেয়েছে। এই অঞ্চলে জারি থাকা কলোনিয়াল আধিপত্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে তাঁর ভাষা ও সাহিত্যকর্ম ছিল মস্তবড় প্রতিবাদ।কখনও স্বাধীনতা সংগ্রামী তিতুমীর কিংবা ক্ষুদিরাম তাঁর কবিতার নায়ক হয়েছেন। কখনওবা কৃষকশ্রেণীর প্রাণের দেবী খনা কিংবা বৈষ্ণব নিমাই আবার কখনও তরুণ লালন তাঁর কাব্যের সাথী হয়েছেন।তাঁর সাহিত্যের বেশিরভাগ উপাদানই বাংলার হাজার বছরের সম্পদ।এই অঞ্চলের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী যারা কিনা সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকভাবে শত শত বছর ধরে বঞ্চিত-নির্যাতিত-নিপীড়িত আল মাহমুদ তাদের হয়ে তাঁর সাহিত্যে কথা বলেছেন।
আল মাহমুদ চলে গেলেন তাঁর প্রিয় শুক্রবারে। অন্ধ, বর্বর, গণমানুষের অভিসম্পাত নিয়ে যারা ক্ষমতার মসনদে বসে আছে তাদের অনুগ্রহ ছাড়াই। একইসাথে আল মাহমুদের দৈহিক মৃত্যুর দ্বারা নতুন যুগের সূচনা করলেন, হাতে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন কারা নিজেদের প্রগতিশীলতা চর্চার নামে ভণ্ডামী করছেন! কারা আমাদের ভাষা, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশ নিয়ে ব্যবসা করে খাচ্ছেন! যাইহোক, পৃথিবীর তাবৎ বড় ও মহান শিল্পীদের মত আল মাহমুদও মাথা নত করেননি।
আল মাহমুদের সময়ে জন্মানোর মত সৌভাগ্য আমার হয়েছে। তাঁর পবিত্র হাতের স্পর্শ আমার মাথায় নিতে পেরেছিলাম বলে আমি ধন্য। আজ যখন বায়তুল মোকাররমে তাঁর জানাজায় দাঁড়িয়েছিলাম তখন আমার অন্তরাত্মা বারবার গেয়ে উঠল সালাম আল মাহমুদ! সালাম! সালাম!
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।